অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

তাজউদ্দীন আহমদ

ইতিহাস যাঁকে আড়াল করেছে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি; ভেতরের নানা সমীকরণ ও সংঘাত; ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের জন্য মূলধারা ’৭১ গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহান বিজয়ের মাসে মূলধারা ’৭১ এবং গ্রন্থটির মূল চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে লিখেছেন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ

মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর মধ্যে অনেকগুলো মুদ্রণ হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি; ভেতরের নানা সমীকরণ ও সংঘাত; ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনের জন্য গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের মূল চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদ, একাত্তরের মূলধারার কেন্দ্রীয় সংগঠক, যিনি ১৯৭৪ সালেই মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কৃত হন, নিহত হন ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় সংগঠক হলেও তিনি রাষ্ট্রীয় নীরব অসম্মানের শিকার হয়েছেন।

মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের শক্তিশালী দিক হচ্ছে, এর সব বক্তব্যই নানা দলিল দ্বারা সমর্থিত—নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ডায়েরি, স্মৃতিচারণা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, বিভিন্ন বৈঠকের ধারাবিবরণী, তখন ও পরবর্তীকালে নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। গ্রন্থে উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয় ও তথ্য অনেকের কাছে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। তবে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর আজ অবধি এই গ্রন্থের যুক্তি বা তথ্য খণ্ডন করে কোনো প্রকাশনা বের হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বরং মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নামে প্রকাশিত বইটি এরই ধারাবাহিকতা বলে গণ্য করা যায়।

মূলধারা ’৭১ বইয়ের প্রচ্ছদ

খুব সংক্ষেপে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে মার্চ মাস থেকেই মূল আলোচনা শুরু। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি গণহত্যা শুরু হয়, শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীনের দায়িত্ব তখন আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে দ্রুত ভারতে পৌঁছালেও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে আরও বিলম্ব হয়। মার্চের প্রথম দিকে ভারতের হাইকমিশনের সঙ্গে তাজউদ্দীনের কিছু যোগাযোগ হলেও ভারতে গিয়েই তিনি নিশ্চিত হন যে ‘ভারতের সঙ্গে কোনো ব্যবস্থাই নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।’ (পৃ. ১১)

শরণার্থীরা তত দিনে বিশাল আকার নিয়েছে, যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহীদের সংখ্যাও বাড়ছে। ভারত সরকারের সঙ্গে কে কোন কর্তৃত্বে কথা বলবে? তাজউদ্দীন দিল্লি যান এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বৈঠক করেন। এই সময় পর্যন্তও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে অন্য নেতাদের অনেকের যোগাযোগ হয়নি, সরকার গঠন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই পর্যায়ে মঈদুল হাসান ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন—ওই সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠন করে তার প্রতিনিধিত্ব না করলে বৈঠক সফল হতো না। তাই তিনি নিজেকে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দেন। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়। কিন্তু তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেকে বিতর্ক তোলেন। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন গ্রুপ তাজউদ্দীনের বিরোধিতায় এই বিষয়কে বরাবর একটি ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে।

মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের শক্তিশালী দিক হচ্ছে, এর সব বক্তব্যই নানা দলিল দ্বারা সমর্থিত—নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ডায়েরি, স্মৃতিচারণা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, বিভিন্ন বৈঠকের ধারাবিবরণী, তখন ও পরবর্তীকালে নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা মূলত তিনটি ধারা দেখি। প্রথমত, অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী। এটাই হলো মূলধারা, যার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাজউদ্দীন। দ্বিতীয়ত, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল-রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বিএলএফ, যা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হয়। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘র’ সরাসরি এই বাহিনী তত্ত্বাবধান করত। এই মুজিব বাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন জেনারেল ওবান, যিনি এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তিব্বতের বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণেও সক্রিয় ছিলেন। তৃতীয়ত, দেশের ভেতরে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ বাহিনী, যার মধ্যে টাঙ্গাইল, পেয়ারাবাগান ও শিবপুর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রথম দুটি ধারার বিরোধ কখনোই নিষ্পত্তি হয়নি, কখনো কখনো তা সহিংস রূপও নিয়েছে। তাজউদ্দীন যে ভারত সরকারের কাছে মুজিব বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন, ক্ষোভ জানিয়েছেন, তার উল্লেখ বইয়ে অনেকবারই পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মার্কিনপন্থী একটি গ্রুপও সক্রিয় ছিল। এই দুই গ্রুপের কোনো না কোনো দিক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন দলীয় নেতা তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিয়ে সার্কুলারও দিয়েছিলেন। (পৃ. ২৩, ৮৬ ও ৯১)

মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বামপন্থীরা তখন মস্কো ও পিকিং—এ দুই পন্থী রাজনীতিতে বিভক্ত। দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন যত বিস্তৃত হচ্ছিল, যুদ্ধ তত বেশি গেরিলা রূপ নিচ্ছিল, যুদ্ধে আগ্রহী বামপন্থী সংগঠন ও কর্মীদের ভিড় তত বেশি বাড়ছিল। কিন্তু যুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে ভারত সরকার থেকে শুরু করে মুজিব বাহিনী পর্যন্ত সবার শক্তিশালী প্রতিরোধ ছিল। মঈদুল জানান, ‘বিদ্রোহী ও বামপন্থীদের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথম দিকে ছিল অতিশয় প্রবল।’ (পৃ. ২২)

১৯৭১ সালে চীনের পাকিস্তানমুখী ভূমিকার কারণে কিছু পিকিংপন্থী নেতা প্রতিক্রিয়াশীল তাত্ত্বিক অবস্থান গ্রহণ করলেও কর্মী ও নেতাদের বিশাল অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অনেকে দেশে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন, কেউ কেউ ভারতে গিয়ে যোগ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিকিংপন্থীরা তো বটেই, মস্কোপন্থী ন্যাপ, সিপিবি, ইউনিয়নের কর্মীদেরও প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয় (পৃ. ৯৪)। এ পরিস্থিতির নানা দৃষ্টান্ত মুশতারী শফীর গ্রন্থেও পাওয়া যায়।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা মূলত তিনটি ধারা দেখি। প্রথমত, অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী। দ্বিতীয়ত, শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী। তৃতীয়ত, দেশের ভেতরে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ বাহিনী, যার মধ্যে টাঙ্গাইল, পেয়ারাবাগান ও শিবপুর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আসামের ধুবড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশের পর মাওলানা ভাসানী কলকাতা আসেন এবং তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শের পর চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের অনুরোধ জানিয়ে আলাদাভাবে তারবার্তা পাঠান। ভাসানী চীনের মাও সে–তুং ও চৌ এনলাইকে যে দীর্ঘ তারবার্তা পাঠান, তার একটি অংশ গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আইডিওলজি অব সোশ্যালিজম ইজ টু ফাইট এগেইনস্ট অপ্রেশন...ইফ ইয়োর গভর্নমেন্ট ডু নট প্রোটেস্ট দিস ব্রুটাল অ্যাট্রোসিটিজ কমিটেড অন অপ্রেসড ম্যাসেস অব বাংলাদেশ বাই দ্য মিলিটারি জান্টা উইথ দ্য হেল্প অব ভেস্টেড ইন্টারেস্ট অব ওয়েস্ট পাকিস্তান, দ্য ওয়ার্ল্ড মে থিংক দ্যাট ইউ আর নট দ্য ফ্রেন্ড অব অপ্রেসড পিপল।’ (পৃ. ৮৪)

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ভারতের প্রথমেই কোনো স্পষ্ট অবস্থান ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার স্বার্থের অনুকূলে হবে কি না, তা নিয়েও ভারতের কেন্দ্রে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল। ভারতের দক্ষিণপন্থীরা চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় পাকিস্তান এ সমস্যার মীমাংসা করুক (পৃ. ২৯)। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারত স্পষ্ট ও নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থী, বিশেষত মস্কোপন্থী সংগঠনগুলোর উদ্যোগ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহকে নিয়ে ‘জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন এই তাগিদেরই বহিঃপ্রকাশ। তাজউদ্দীনসহ কেউ কেউ ‘সর্বদলীয় জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গঠন করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হয়ইনি, ভেতর থেকে বাধার কারণে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিও কার্যকর থাকতে পারেনি। বিভিন্ন ধারা ও শক্তিকে একীভূত করে মুক্তিযুদ্ধের যে রূপ দেওয়া সম্ভব হলো না, তার ধারাবাহিকতা আমরা স্বাধীনতার পরও দেখতে পাই।

আলোচনারত (বাঁ থেকে) কর্নেল ওসমানী, জেনারেল মানেকশ ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

সে সময় তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রচারণা, কুৎসা রটনায় পরস্পবিরোধী নানা গ্রুপের ঐক্যও দেখা যায়। এই জটিল সমীকরণের মধ্যে তাজউদ্দীন যে দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা নিয়ে কাজ করেন, তার ফলে বড় বিভক্তি ও বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হয়। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁর প্রাণনাশের চিন্তাভাবনাও যে করা হয়েছিল, তারও একটি তথ্য গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। (পৃ. ১৩৩)

সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন কীভাবে যুক্ত হলো, তার বৃত্তান্ত, আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, সোভিয়েত ভূমিকা গ্রহণের পর ইয়াহিয়ার অবস্থানগত পরিবর্তন, মোশতাকের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি নানা দলিলের উল্লেখ আছে এই গ্রন্থে। সেপ্টেম্বরের পর থেকেই বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান স্পষ্ট হতে থাকে। এই পর্যায়ে ভারত যৌথ বাহিনী গঠন করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের মধ্যেই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এর মধ্যে জাতিসংঘের ভূমিকা, চীন কী কারণে পাকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে এল না, মার্কিন সপ্তম নৌবহর কীভাবে থেমে গেল প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় বইটিতে।

যুদ্ধ তত বেশি গেরিলা রূপ নিচ্ছিল, যুদ্ধে আগ্রহী বামপন্থী কর্মীদের ভিড়ও তত বাড়ছিল। কিন্তু যুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে ভারত সরকার থেকে মুজিব বাহিনী পর্যন্ত সবার শক্তিশালী প্রতিরোধ ছিল। ‘বামপন্থীদের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথম দিকে ছিল অতিশয় প্রবল।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরবর্তী পরিস্থিতির বর্ণনাও আছে গ্রন্থে—কীভাবে হঠাৎ দেশে ভুঁইফোড় মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটল, কীভাবে তারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করল। বলা হয়েছে,
‘১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর এই বাহিনীর উৎপত্তি ঘটে বলেই অচিরেই ঢাকাবাসীর কাছে এরা “Sixteenth Division” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কালক্ষেপণ না করে এদেরই একটি অংশ অন্যের গাড়ী, বাড়ী, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে।...সুযোগসন্ধানী “সিক্সটিন্থ ডিভিশন” সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে।’ (পৃ. ২১৮)

একটু পরেই ২২০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,
‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের সূত্রপাত হয় যখন দৃশ্যত কিছু শিখ অফিসার এবং তাদের অধীনস্থ সেনা যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এবং খুলনার ক্যান্টনমেন্ট ও শিল্প এলাকায় লুটপাট শুরু করে।’

১৬ ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলেও অস্থায়ী সরকার দেশে আসে ২২ ডিসেম্বর। এই বিলম্ব নিয়ে তখন থেকেই প্রশ্ন আছে। তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মঈদুল লিখেছেন,
‘বাংলাদেশ সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত ভারতের প্রধান কর্মকর্তা ডি পি ধর সপ্তম নৌবহর উদ্ভূত জরুরী পরিস্থিতির জন্য ১১ই ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি অবধি মস্কোয় অবস্থান করেছিলেন। ১৮ই ডিসেম্বরে ডি পি ধর কলকাতা এসে পৌঁছাবার পর ২১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে তাঁর আলোচনা চলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অনুরোধ ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে।’ (পৃ. ২২১)

মুক্ত যশোরে জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

এ কারণে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রিসভাকে ভারতে থাকতে হয় এবং ২২ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় ফেরত আসে। কিন্তু এ সময় কী কী সিদ্ধান্ত বা চুক্তি হয়েছিল, এটা বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছিল কি না, এ বিষয়ে গ্রন্থে পরিষ্কার কিছু পাওয়া যায় না। তবে কোনো যুক্তিতেই প্রবাসী সরকারের বিলম্বে আগমন গ্রহণযোগ্য হয় না।

পুরো মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তিনিই ছিলেন নেতা, সরকারের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাজউদ্দীনই ছিলেন প্রধান সংগঠক। ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনের আগপর্যন্ত বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ, দেশের গতিমুখ নির্ধারণে তাজউদ্দীনের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। শেখ মনিসহ অসন্তুষ্ট বিরোধী অনেকেই শেখ সাহেবের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। প্রত্যাবর্তনের পরদিন সকালে সরকার পুনর্গঠন নিয়ে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আলোচনায় বসেন। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গ্রন্থে এরপর বলা হয়েছে,
‘বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দর্শনার্থীর অধৈর্য ভিড়। সকাল দশটায় আহূত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগদানের তাড়া। ফলে দু’জনের আলোচনা আর এগোতে পারেনি। তাজউদ্দীন জানান তাঁর আরো কিছু জরুরী কথা বলার ছিলো—মুক্তিযুদ্ধের এই সাড়ে ন’মাসে কোথায় কী ঘটেছে, কোন নীতি ও কৌশলের অবলম্বনে, কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কী পরিবর্তন ঘটেছে দেশবাসীর মনোজগতে, তরুণদের প্রত্যাশা ও মূল্যবোধে। কেননা, এসবকিছুর মাঝেই নিহিত ছিল দেশের পরবর্তী সংগ্রামের, তথা, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সংহত ও স্থিতিশীল করার এবং সাধারণ দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইকে সাফল্যমণ্ডিত করার মূল সূত্র। কিন্তু তখন এসবকিছুই আলোচনার সময় ছিল না। পরেও কখনো সে সুযোগ তাজউদ্দীনের ঘটে ওঠেনি।’ (পৃ. ২৩৯)

তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক, ‘বিদেশি সাহায্য’, উন্নয়ন, পরিকল্পনা যেভাবে চিন্তা করেছিলেন, তার সঙ্গে শেখ মুজিবের অবস্থানের ভিন্নতা ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। সম্ভবত এ কারণেই ১৯৭৪ সালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের আগে আগে তাজউদ্দীন মন্ত্রিপরিষদ থেকে বহিষ্কৃত হন। ‘নতুন’ রাষ্ট্র পুরোনো উন্নয়ন ধারাতেই ফেরত যেতে থাকে। রক্ষীবাহিনী গঠন, বাকশালসহ নানা উদ্যোগের সঙ্গেও তাজউদ্দীন একমত ছিলেন না।

এরপর সেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ নির্বাচিত, আবার ২০০৮ থেকে একটানা নির্বাচিত–অনির্বাচিত অবস্থায় ক্ষমতায় থেকেছে ১৫ বছরের বেশি। শেষের ১০ বছরে চারদিকে নামকরণের উন্মাদনা দেখেছি। কিন্তু এত সবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের কোনো স্থান ছিল না, তাঁর নামও উচ্চারিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় ব্যক্তির এই পরিণতি কেন? মুক্তিযুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল? এত ত্যাগ ও সংগ্রামের পরও এই দেশের এই হাল কেন? এই প্রশ্নগুলো ঘুরছে, বাড়ছে। উত্তর পেতে হলে আরও অনেক বই–দলিলপত্রের সঙ্গে মূলধারা ’৭১ও পাঠ্যতালিকায় রাখতে হবে।