পাঠকের ভাবনা

জলবায়ু খাতে বরাদ্দ কি এবারও অপ্রয়োজনীয়ভাবে খরচ করা হবে

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা জেলার গাবুরা ইউনিয়ন
ছবি: প্রথম আলো

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৩তম ও দেশের ৫১তম বাজেট উত্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান, শিক্ষাসহ বেশ কিছু খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে। এ বছর বাজেটের মোট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার মধ্যে সরকার পরিচালনা খাতের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

উন্নয়ন খাতের টাকাগুলো পর্যায়ক্রমে ভাগ করে দেওয়া হবে পরিবহন, যোগাযোগ, জ্বালানি, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, জলবায়ু, পরিবেশসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় অর্থাৎ পায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। জ্বালানির এই বরাদ্দ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে খরচ করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। যা হবে, সরকারের আগামী অর্থবছরের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প।

এ ছাড়া উন্নয়ন খাতের ব্যয়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো শিক্ষা, চতুর্থ গৃহায়ণ গণপূর্ত, পঞ্চম স্বাস্থ্য, ষষ্ঠ স্থানীয় সরকার, সপ্তম কৃষি, অষ্টম পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সম্পদ; নবম শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা, দশম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এর বাইরেও বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।

এবার আসা যাক মূল পয়েন্টে, প্রস্তাবিত বাজেটের বরাদ্দের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। (২০২২-২৩) অর্থবছরে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সম্পদে বরাদ্দ পেয়েছে ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে রাখা হয়েছে ৭৩৮ কোটি ৬৯ লাখ, যা মোট বরাদ্দের ৪৯ দশমিক ২০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেট থেকে ১৩৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন তীব্র হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নাজুক অবস্থায় আছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যার জন্য মূল দায়ী উন্নত বিশ্ব। আমরা কি সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আমাদের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছি? আর যেটুকু আদায় করি, সেটার যাতায়াত স্থানে ব্যবহার করি? প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলন এলেই অনেক বেশি আলোচনা হয় এসব বিষয় নিয়ে। কিন্তু সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়, সেটা বাস্তবায়ন হয় কতটুকু!

এ বছরের বাজেটে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখছে। তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যা–ই হোক, তা বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এর আগে অনেক বাজেটের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ে বরাদ্দকৃত টাকা জলবায়ু ও পরিবেশের বিধ্বংসী বিষয়ে খরচ করার অভিযোগ করেন কেউ কেউ। যেমন ২০২১ সালে জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় উপকূলীয় বন বিভাগে লাগানো হয়েছিল আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসগাছ। এগুলো মাটির গুণ নষ্টের পাশাপাশি দেশীয় গাছেরও ক্ষতি করে। বিপুল পরিমাণ পানি শোষণ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নামিয়ে দেয়। আশপাশে ফসলও ভালো হয় না।
শুধু তা–ই নয়, আমরা এর আগের আরও দেখেছি জলবায়ু তহবিলের টাকায় অবাস্তব সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বিগত বছরগুলোয় লক্ষ করলে দেখা যাবে, জলবায়ু ফান্ডের টাকায় বিভিন্ন স্থানে পার্ক নির্মাণ, পদচারী–সেতু, ট্রাফিক বাতি, টয়লেট নির্মাণ, বিদেশে শিক্ষা সফর উল্লেখযোগ্য; যে বিষয়গুলো তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
তাই আমার মতে, জলবায়ু খাতে কী পরিমাণ বরাদ্দ পেয়েছে, সেটা মূল বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

এটা তো সবারই জানা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন তীব্র হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নাজুক অবস্থায় আছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যার জন্য মূল দায়ী উন্নত বিশ্ব। আমরা কি সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আমাদের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছি? আর যেটুকু আদায় করি, সেটার যাতায়াত স্থানে ব্যবহার করি? প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলন এলেই অনেক বেশি আলোচনা হয় এসব বিষয় নিয়ে। কিন্তু সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়, সেটা বাস্তবায়ন হয় কতটুকু!

২০২২-২৩ অর্থবছরের জলবায়ু ও পরিবেশের জন্য বরাদ্দকৃত সব টাকা এ খাতেই ব্যবহার হবে এমন প্রত্যাশা সবার। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়াই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য।

পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটে নিষিদ্ধ পলিথিনে বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানাই। কারণ, এতে দেশে পলিথিন ব্যাগের দাম কমার আশঙ্কা আছে। আর দাম কমলে পলিথিনের ব্যবহার বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশদূষণও বাড়বে। তাই পরিবেশ–বিধ্বংসী পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করার জোর দাবি জানাই। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ পলিথিনে পৃথিবী ও মানুষের মৃত্যু অনিবার্য।

ডি এইচ মান্না
ইয়ুথ ক্লাইমেট অ্যাকটিভিস্ট (সিলেট)
ইমেইল: dhmanna17@gmail.com