Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্ষণের ‘মহামারি’ ও এক মান্দাইয়ের হাসি

দেশটি হোক নারীদের জন্য নিরাপদ, মারিয়া মান্দাইর হাসির মতো

পত্রিকার প্রতিবেদকদের যার যার বিটে বছর শেষে সালতামামি করার রেওয়াজ রয়েছে। এবার লেখার আগে নারী ও শিশু বিটের কর্মী হিসেবে পুরো বছরের একটা ‘মানসিক ভ্রমণ’ দিয়ে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম আলোচিত কী কী আছে। তবে বছরের শেষ প্রান্তের তিনটা ঘটনা জানান দিল লেখায় পুরোনোগুলোর উল্লেখ অল্পস্বল্প করলেও চলবে। তিনটি ঘটনাই ধর্ষণের। তাহলে বিশেষভাবে তিনটির উল্লেখই-বা কেন! ধর্ষণ ঘটছেও প্রতিদিন। শুধু ঢাকায় জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাসে দিনে গড়ে ২টি ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার মামলা হচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হচ্ছে দিনে গড়ে ৬টির বেশি। গত বছরের চেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা এবার ৩ শতাংশ বেশি (সূত্র: ঢাকা মহানগর পুলিশ)।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ১১ মাসের হিসাব ধরলে আপনি প্রতিদিন প্রায় ৪টি ধর্ষণের খবর পত্রিকায় পড়েছেন। অন্যান্য নির্যাতন ধরলে এ-সংক্রান্ত খবরে আপনার চোখ আটকেছে আরও বেশি। নিত্যদিন সহিংসতার খবর দেখে আপনি অভ্যস্ত হয়ে পড়ার বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাচ্ছেন কি না, সে রায় আমি দিতে পারি না। বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জনতার রায়’ গল্পের শুরুর মতো বলতে চাই না, ‘হিসেব করে দেখলে এই শহরে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। অধিকাংশেরই এতে বিচলিত হওয়ার অবসর থাকে না...।’ তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, ওই তিনটি ঘটনায় তিনটি শব্দ আপনার-আমার বুকে ধাক্কা দিয়েছে। এক. ‘কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার’ (কক্সবাজার, ২২ ডিসেম্বর), দুই. ‘সন্তানদের আটকে রেখে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে ধর্ষণ’ (বান্দরবান, ২২ ডিসেম্বর), ৩. ‘উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে’ চলন্ত বাসে ধর্ষণ (নারায়ণগঞ্জ, ১৯ ডিসেম্বর)। আমার চোখে ধাক্কা খাওয়া শব্দগুলো উদ্ধার-চিহ্নে বেঁধে দিলাম।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় মামলা করা মেয়েটির নম্বরে ফোন দিলাম ২৫ ডিসেম্বর। মামলার এজাহার অনুযায়ী, গৃহবধূ পরিচয়ের মেয়েটির বয়স মাত্র ১৮ বছর। এ বছরের ১১ মাসে চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের যে ৩৪টি খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে (সূত্র: বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি), তার মধ্যে ১৮ বছরের মেয়েটির ঘটনা এখনো যুক্ত হয়নি। মেয়েটির সঙ্গে কথা শেষ করার আগে আগে বললাম, ‘আপনার কোনো প্রয়োজন হলে ফোন দিয়েন’। ফোন ছাড়ার আধঘণ্টা পর মেয়েটি ফোন দিয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, একটা উপকার করতে পারবেন! ঘটনার সময় আমার কাছে ঘরভাড়ার তিন হাজার টাকা ছিল। টাকাগুলো ওরা (আসামিরা) নিয়ে নেয়। স্বামী বারবার সেই টাকার কথা তোলে। পুলিশের কাছে টাকাটা আছে কি না, একটু খোঁজ নিতে পারবেন!’ তিন হাজার টাকা আর মামলার বিষয়ে জানতে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহাকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, টাকার বিষয়ে জানা নেই। প্রাথমিক তদন্তে ধর্ষণের সত্যতা পেয়েছেন। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ভুক্তভোগী মেয়ে ও আসামিদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিন আসামির মধ্যে চালক প্রাপ্তবয়স্ক। বাকি দুজন কিশোর।

মেয়েটি আমাকে বলেছিলেন, তিনি আসামিদের শাস্তি চান। স্বামী এখন পর্যন্ত তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন। তবে আসামিদের সাজা না হলে এই সমর্থন কত দিন থাকবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। আমি ভাবছিলাম, এ দেশে মামলার যে দীর্ঘসূত্রতা, মেয়েটি মামলাটি নিয়ে ঠিক কতখানি যেতে পারবেন। যাঁকে স্বামীর ‘কথা শোনার ভয়ে’ ঘরভাড়ার তিন হাজার টাকার খোঁজ নিতে হয়, তিনি কত দিন বিত্তবিহীন অবস্থায় লড়াই করার শক্তি ধরে রাখবেন?

কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ভেতর কাহিনিতে কম মোচড় আসেনি। গত সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সংবাদ সম্মেলনে জানায়, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত আট মাসের সন্তানের চিকিৎসার জন্য পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকা মেয়েটি আসামিদের নজরে পড়েন। ৫০ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে মেয়েটিকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।

বিষাদ-বিষণ্নতা নয়, আশাই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। স্বপ্ন আগামী দিনের জন্য বাধা ডিঙাতে উৎসাহ জোগায়। দেশটি নারীর জন্য তেমন নিরাপদ হোক যেন নারীরা মান্দাইয়ের মতো হাসিতে ভাসতে পারে। স্বপ্ন হোক অনেক বড়।

মেয়েটি গত বছর সিলেটের এমসি কলেজে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মতো স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাননি। কিন্তু দুটি ঘটনায় মিল একটাই, দুজনই ভুক্তভোগী। এসব ঘটনা একটি নারীকে ভীতি, সংকুচিত করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট। আমি নিজে নারী হিসেবে এসব ঘটনায় প্রভাবিত হই।

নভেম্বর মাসে পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে বেড়াতে গিয়ে নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। নির্জন, অন্ধকার সরু রাস্তায় চলতে গিয়ে গাড়ির ভেতরে বসেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মাস দু-এক আগে স্বামী, শিশুসন্তান নিয়ে কাশফুল দেখতে গিয়ে একপর্যায়ে অনেক গভীরে চলে গিয়েছিলাম। আশপাশে দু-একজন লোক ছাড়া কেউ ছিল না বলে হঠাৎ ভয় এসে গ্রাস করল। সৌন্দর্য উপভোগে সমাপ্তি টেনে আক্ষরিক অর্থেই পালিয়ে এলাম। গত বছর কুয়াকাটায় বেড়াতে গিয়ে খুব ভোরে সাগর দেখতে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। হোটেল থেকে সাগরে দ্রুত পৌঁছানোর একটি মাটির পথ পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম, তত দ্রুতই মিইয়ে গিয়েছিলাম যখন দেখলাম চারপাশ খুব বেশি নির্জন। শেষ পর্যন্ত লোক চলাচল বেশি এমন পথ ধরেছিলাম সাগর ছুঁয়ে দেখতে।

তবে এমন মনোভাব সমস্যার সমাধান আনে না, সমস্যা বাড়ায়। ছুটতে হবে, লড়তে হবে, নিজের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে—তবেই তো এগোনো যাবে। সঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সংখ্যা বাড়লে সেই পথ চলা কিছুটা সহজ হবে। সরকারপ্রধানও নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধানের উপায় বলে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ ডিসেম্বর ‘বেগম রোকেয়া দিবস উদ্‌যাপন’ এবং ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা আমাদের জন্য পীড়াদায়ক, তা হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন করেছি। কিন্তু শুধু আইন করলেই এসব বন্ধ করা যাবে না, এ জন্য মানসিকতাও বদলাতে হবে। চিন্তাচেতনার পরিবর্তন আনতে হবে এবং বিশ্বাসটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। এই বিশ্বাসটা করতে হবে যে নারীরা কেবল ভোগের বস্তু নয়, নারীরা সহযোদ্ধা।’ (সূত্র: ইত্তেফাক)

যেদিন কক্সবাজার ও বান্দরবানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই ২২ ডিসেম্বরই বাংলাদেশের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছে মারিয়া মান্দাইয়ের দল। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ফাইনালে আনাই মগিনির করা একমাত্র গোলে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জয় করেছে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দল। মেয়েদের হাসিতে হেসেছে পুরো বাংলাদেশ। জয়ের পর ‍প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধিনায়ক মারিয়া মান্দাই বলেছিলেন, এটা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসীকে দেওয়া উপহার।

বিষাদ-বিষণ্নতা নয়, আশাই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। স্বপ্ন আগামী দিনের জন্য বাধা ডিঙাতে উৎসাহ জোগায়। দেশটি নারীর জন্য তেমন নিরাপদ হোক যেন নারীরা মান্দাইয়ের মতো হাসিতে ভাসতে পারে। স্বপ্ন হোক অনেক বড়।

উত্তর আমেরিকায় ক্যারিবীয় সাগরে ‘সেন্ট লুসিয়া’ নামে বিশ্বে একটি দেশই আছে, যেটি এক মহীয়সী নারীর নামে নামকরণ হয়েছে (অবশ্য আয়ারল্যান্ডের নাম এরা দেবীর নামে নামকরণ বলা হয়)। মনে সাধ জাগে, নারীর প্রতি সহিংসতা শূন্যে নামিয়ে প্রথম দেশ হিসেবে উচ্চারিত হোক বাংলাদেশের নাম।

নাজনীন আখতার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো