Thank you for trying Sticky AMP!!

পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোড়া রোগী

১৯৭৩ সালে এমবিবিএস পাস করে প্লাস্টিক সার্জারিতে একজন তরুণ ও নবীন চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম ১৯৭৫ সালে। পরে ১৯৮০ সালে আমি আমার শিক্ষাগুরু প্রয়াত অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ সাহেবের অধীনে যোগ দেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করতে করতেই পোড়া রোগীদের চিকিৎসার দুরবস্থার বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। প্রয়াত অধ্যাপক শহীদুল্লাহ ও প্রয়াত অধ্যাপক মো. কবির উদ্দিন স্যারের নেতৃত্বে সেই ১৯৮৬ সালে প্রথম তৎকালীন সরকারের কাছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে আলাদা একটি স্বতন্ত্র বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট খোলার প্রস্তাব দিই। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিট একদম স্বতন্ত্র একটি ছয়তলা ভবনে কার্যক্রম শুরু করে।
এখন ২০১৩ সাল। আমার ব্যক্তিগত ৩০ বছরের বেশি এবং বার্ন ইউনিটের ১০ বছরের বেশি, এই দুই মিলিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা। বর্তমানে আমি অবসরপ্রাপ্ত। কিন্তু বার্ন ইউনিট থেকে অবসর নিতে পারিনি। অনেকটা আমার ব্যক্তিগত মনের তাগিদে। কারণ, এই হাসপাতাল আমার সন্তানের মতো। মানুষ বিভিন্ন কারণে অগ্নিদগ্ধ হয়। এর মধ্যে চুলার আগুন থেকে পোড়া, গরম পানিতে পোড়া ও বৈদ্যুতিক তারে পোড়া আমাদের দেশের অন্যতম কারণ। তবে যে কারণেই মানুষ পুড়ে যাক না কেন, পুড়ে যাওয়া মানুষের ভীষণ যন্ত্রণা হয়, যা আমি অনেক বছর ধরে দেখে আসছি।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য একটাই। পুড়ে যাওয়া রোগীদের দুঃসহ যন্ত্রণা আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে নিজ চোখে দেখেছি। একটা আকুল আবেদন জানাতে চাই সবার কাছে, অসাবধানতার কারণেই হোক কিংবা অতিসাম্প্রতিক সহিংসতার কারণেই হোক, মানুষকে যেন কোনোভাবেই পুড়তে না হয়। এক মাস ধরে সহিংসতার শিকার হয়ে যেসব রোগী আমাদের হাসপাতালে আসছে, তাদের যন্ত্রণা অন্যান্য পোড়া রোগী থেকে ভয়াবহ। কারণ, এই রোগীদের বেশির ভাগেরই মুখমণ্ডল পুড়ে যাচ্ছে। এতে তাদের শ্বাসনালি পুড়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের বিঘ্ন ঘটছে। আর একজন মানুষ যদি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে না পারে, তাহলে কী যে কষ্ট, তা আশা করি অনুমান করা যায়।
আমরা চিকিৎসাক্ষেত্রে অনেক সময় এই অসহায় রোগীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ি। আমাদের কিছুই করার থাকে না। কোনো চিকিৎসকই তাঁর চোখের সামনে একজন রোগীকে এভাবে মারা যাওয়া মেনে নিতে পারেন না। আমরা চিকিৎসকেরা যখন কাউকে জরুরি চিকিৎসা দিচ্ছি, তখন কিন্তু আমরা জানি না সেই রোগীর ধর্ম, বর্ণ ও পরিচয়। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার কষ্ট লাঘব করা এবং তাকে সুস্থ করে তার প্রিয়জনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।
সম্প্রতি আমি বলেছিলাম, আমাদের যেন আর কোনো অ্যাসিডে আক্রান্ত বা পোড়া মেয়েকে চিকিৎসা করতে না হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আজও ঠিক একইভাবে বলছি, আমাদের যেন আর এই সহিংসতার কারণে কোনো Inhalation Burn Injury (শ্বাসনালির পোড়া) রোগীকে চিকিৎসা না করতে হয়। কারণ, এগুলো এত কষ্টের যে চিকিৎসকের বাইরে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে এবং আমার শেষ জীবনে এই ঘটনাগুলো আমার জন্য চরম কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে। আমি আমার জীবন শুরু করেছিলাম একজন অনেক বড় প্লাস্টিক সার্জন হব এবং মানুষের চেহারার সৌন্দর্যবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত থাকব বলে। কিন্তু বাংলাদেশের পোড়া রোগীদের দুরবস্থা দেখে গত ৩০ বছর আমি আমার ব্যক্তিগত কাজ ছেড়ে এই মানুষগুলোর মঙ্গলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদের কষ্ট আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।
আমাদের হাসপাতালে শাহবাগে বাসের আগুনে পোড়া রোগীরা যেদিন আসে, সেদিন আমি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি আমাদের চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেবা দিয়েছিলেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
সব শেষে আবারও একটি আকুল আবেদন, আর যেন এ ধরনের রোগীদের আমাদের চিকিৎসা না করতে হয়।
ডা. সামন্ত লাল সেন: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বার্ন ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।