অরণ্যে রোদন

বাঁধ দিয়ো না

‘মাটি আমাদের
পানি আমাদের
বনও আমাদের
আমাদের পূর্বপুুরুষরা এসব গড়ে তুলেছেন
আমরা এসব রক্ষা করব।’
—একটি পুরোনো চিপকো সংগীত
রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ খুবই নিষ্ঠুর এক কবিতা। মা রেগে সন্তানকে বলেছিলেন, চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে। সমুদ্রদর্শন শেষে তীর্থযাত্রীদল যখন ফিরছে, তখন উঠল ঝড়।
চারিদিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে, আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে।
তখন প্রশ্ন উঠল, দেবতার ধন কে যায় ফিরায়ে লয়ে। জনতা বাধ্য করল মাকে, তাঁর শিশুকে সমুদ্রে বিসর্জন দিতে।

কবিতায় বিক্ষুব্ধ জলরাশি কেড়ে নিয়েছে একজনমাত্র শিশুকে, আর তাকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আরেক জন, কিন্তু সম্প্রতি ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যে পাহাড়ি তীর্থভূমিতে পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে ঠিক কতজন, তার হিসাব কারও জানা নেই। ৩০ জুনের খবর, উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুনা বলেছেন, ঠিক কতজন মারা গেছে কিংবা ভেসে গেছে, তার হিসাব হয়তো কোনো দিনও পাওয়া যাবে না, সংখ্যাটা কয়েক শও হতে পারে আবার কয়েক হাজারও হতে পারে।
ওই এলাকায় মন্দির ছিল অনেকগুলো, কেদারনাথের মন্দির খুবই বিখ্যাত, অনেক তীর্থযাত্রী আর পর্যটক ছিলেন ওই সময় ওই এলাকায়। পাহাড়ি ঢলে রাস্তাঘাট, সেতু সব ভেসে গেছে, ভেসে গেছে মন্দিরগুলো। প্রকৃতির রুদ্ররোষের কাছে অসহায় ছিল সবাই। জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঘটনাস্থলে কেউ পৌঁছাতেই পারছিলেন না, বরং হেলিকপ্টার ধসে মারা গেছেন উদ্ধারকারীরা। প্রকৃতির রুদ্ররোষের কাছে মানুষ যে কত অসহায়, সেটা দেখা গেছে ভারতের উত্তরাখন্ডের এই মহাদুর্যোগের সময়। হাজার হাজার মানুষ ভেসে গেছে, সেতু-যানবাহন-ঘরবাড়ি-স্থাপনা ভেসে গেছে খড়কুটোর মতো।
প্রকৃতির প্রতিশোধ খুবই ভয়াবহ।
যদিও স্থানীয় কারও কারও সংস্কার, তাদের দেবী ধারীকে সরানো হয়েছিল ১৬ জুন রাতে, তারই অভিশাপে এই বিপর্যয়। কেদারনাথে একটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছিল। সে জন্য ওই দেবীবিগ্রহকে সরানোর প্রয়োজন হয়। এলাকার লোক আগে থেকেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিল, দেবীকে সরানোর কথায় তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, কারণ তাদের মধ্যে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, এই এলাকাকে বন্যা-দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্যই এই দেবীর অধিষ্ঠান। দেবীর জন্য বিকল্প মন্দির নির্মাণ করা হয়। ১৬ জুন প্রচণ্ড ঢলের মুখে আদি মন্দিরটা যখন যায় যায়, তখন মন্দির কর্তৃপক্ষই দেবীমূর্তি সরাতে রাজি হয়। সরানোর পরেই ঘটে এই প্রলয়ংকরী ঘটনা, এটা ওই এলাকার কেউ কেউ বিশ্বাস করে। এটা বিশ্বাসের ব্যাপার, সংস্কারের ব্যাপার। এ নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো। কিন্তু এ বিষয়ে কারও মনেই কোনো বিতর্ক নেই যে প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে না দিলে তা ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবেই। বদ্রীনাথ-কেদারনাথের এই মহাপ্লাবনও হচ্ছে প্রকৃতিকে বিরক্ত করার, নষ্ট করার প্রতিক্রিয়া মাত্র। হিমালয় রেঞ্জে প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে খননকাজ চালানো হয়েছে যত্রতত্র, বেহিসাবি। বন কেটে উজাড় করা হয়েছে। আর বানানো হয়েছে একের পর এক বাঁধ। সেসব বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করেছে, ভারতের ও সারা পৃথিবীর পরিবেশবাদীরা জান বাজি রেখে লড়াই করেছে। এমনকি উত্তরাখন্ডের পরিবেশ-প্রতিবেশবিরোধী উন্নয়নকাজ অচিরেই সমূহ বিপদ ডেকে আনবে—এই কথা বলেছেন সেখানকার মহাহিসাবরক্ষক সুন্দরলাল বহুগুনা, তাঁকে কর্তারা উন্নয়নবিরোধী বলে উপহাস করেছিলেন। উত্তরাখন্ডের চিপকো আন্দোলন খুবই বিখ্যাত, স্থানীয় অধিবাসীরা পরিবেশ ধ্বংসরোধে গাছ ধরে মানববন্ধন রচনা করত। ওই আন্দোলন চলে সত্তরের দশক ধরে আজ পর্যন্ত। ওপরে যে গানের পঙিক্ত উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা এই চিপকো আন্দোলনেরই গান, যা এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে।
কিন্তু তবু উন্নয়ন পরিকল্পকদের প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে বাঁচতে পারেনি উত্তরাখন্ড, বাঁচতে পারেনি ভারতের বহু নদনদী, পাহাড়, মানববসতি।
আজকে বদ্রীনাথ-কেদারনাথ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। মনে হবে, মহাপ্রলয় ঘটে গেছে ওই পাহাড়ে ও জনপদে, কিন্তু প্রকৃতি প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে, এক দিনের প্রলয়কাণ্ডে, কিংবা প্রতিদিন একটু একটু করে আঘাত হেনে আরও অনেক এলাকায় আরও অনেক জনপদে ঘটিয়ে চলেছে বিপর্যয়, নিয়ে চলেছে তার ওপরে আঘাত হানার প্রতিশোধ।
ফারাক্কা বাঁধও তার প্রমাণ। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একটা কক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদীর পানি বণ্টন বিষয়ের একটা সেমিনার, গত মে মাসে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবিদ বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) ড. নজরুল ইসলাম আর কলকাতার পরিবেশবিদ পানিবিশেষজ্ঞ জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবন্ধ পাঠ করেন। ড. নজরুল ইসলামের একটা পুস্তিকা আছে, নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট: ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের চাবিকাঠি শিরোনামে।
উভয় বিশেষজ্ঞ আলাদা আলাদা প্রবন্ধে যা বলেন, তার মোদ্দা কথা একই। ভারত-বাংলাদেশের নদীগুলো কেবল পানি বহন করে না। কিউসেক কিউসেক পানির হিসাব করে প্রকল্প করার কোনো মানে হয় না, কারণ নদীগুলো বহন করে প্রচুর পরিমাণে পলি। এই নদীর ওপর নির্ভরশীল মাছসহ অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ, দুই পারের মানুষের জীবন এই নদীর গতি-প্রকৃতির সঙ্গে বাঁধা, এসবে বাঁধ দিয়ে বন্যা দূর করা যাবে না, বরং বাঁধ দিলে নদীর তলদেশ প্রতিনিয়ত উঁচু হবে, বাঁধ ভেঙে যাবে, সৃষ্টি হবে মহাপ্লাবন, বরং গঙ্গাকে বইতে দিলে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত, তা হতে পারত অর্থনীতির সাপেক্ষে লাভজনক। কিন্তু বন্যানিয়ন্ত্রণের নামে, জলবিদ্যুতের নামে, সেচ প্রকল্পের নামে নতুন নতুন বাঁধ দিয়ে পুরো ইকো সিস্টেম ধ্বংস করা হচ্ছে। আরও ভয়ের কথা, ভারতে ভাবা হচ্ছে এক নদীর পানি আরেক নদীতে নিয়ে যাওয়ার সংযোগ খাল কাটার কথা। জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ৬৬ বছরে ভারত-বাংলাদেশ তার ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে মাত্র গঙ্গা বিষয়ে একটা চুক্তি করতে পেরেছে, তা-ও সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই ফারাক্কা প্রকল্প কেবল বাংলাদেশের ক্ষতি করেনি, ক্ষতি করেছে ভারতেরও। তিনি দেখান, কী করে নদী সরে যাচ্ছে ফারাক্কা বাঁধ থেকে, ফারাক্কা কলকাতাকে বাঁচাতে পারেনি, উজানে ৮ মিটার পলিস্তূপ নদীবক্ষে জমা করেছে এবং বন্যার সৃষ্টি করছে, পঞ্চানন্দ গ্রাম ১৫ কিলোমিটার সরে গেছে পুবে। ভারতের রাজ্যগুলো এক নদীর জল অন্য নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংযোগ খাল কাটার প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে, নতুন নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এখন ব্রহ্মপুত্রে চীনও বাঁধ দিচ্ছে, যখন সারা পৃথিবী থেকে বাঁধ বানানোর প্রকল্প সব বাদ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মিয়ানমার চীনের কোম্পানিকে বরাদ্দ দেওয়া বড় বাঁধের প্রকল্প পরিবেশের কথা চিন্তা করে পরিত্যাগ করেছে। দুই দেশের বিশেষজ্ঞই প্রকৃতির ওপরে হাত না দেওয়ার সুপারিশ করেন। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্যই হোক, সেচের জন্যই হোক, আর বিদ্যুতের জন্যই হোক, বাঁধ না দেওয়ার ওপরে জোর দেন।
কথায় কথায় উঠে আসে টিপাইমুখ বাঁধের কথাও। টিপাইমুখ বাঁধে সেচের জন্য পানি সরানো না হলেও এতে বর্ষাকালে ভাটিতে পানি কমবে, শীতকালে বাড়বে, হাজার বছরের ইকো-সিস্টেমে পরিবর্তন দেখা দেবে, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, আমরা জানি না।
আজকে উত্তরাখন্ডে যে ভয়াবহ বিপর্যয় হয়ে গেল তা থেকে কি আমরা, প্রকৃতিবাসী মানুষেরা শিক্ষা নেব? টিপাইমুখ বাঁধ যদি একই রকম পাহাড়ি ঢলের শিকার হয়, বাঁধ ভেঙে গেলে ভাটিতে বাংলাদেশের কী পরিণতি হবে, ভারতের অংশেরই বা কী পরিণতি হবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মুক্তধারা নাটকে বাঁধ ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আজকে ভারতের সব পরিবেশবাদী পৃথিবীর অন্য সব পরিবেশবাদীর সঙ্গে একত্র হয়ে বলছেন বাঁধ না দেওয়ার কথা, এক নদীর পানি আরেক নদীতে না নিয়ে যাওয়ার কথা; অরণ্য, পাহাড়, নদী, মানববসতি ধ্বংস না করার কথা। বাঁধ যে জলবায়ুবান্ধব তা-ও নয়, জলাধারও প্রচুর কার্বন নির্গমন করে।
কেদারনাথের কিছু মানুষ বিশ্বাস করে, জুনের মহাপ্লাবন ঘটে গেছে ধারী দেবীর বিগ্রহ সরানোর কারণে। আর বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ধরনের দুর্যোগ মনুষ্যসৃষ্ট, এসবের কারণ মানুষের অপকর্ম, প্রকৃতিকে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারিত করা, বন ধ্বংস, খনি খনন, বিস্ফোরণ ঘটানো, গাছ কাটা, বাঁধ নির্মাণ। এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বরফের গলে যাওয়া।
ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক সবার জন্যই লাভজনক। উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত কেবল বাংলাদেশকেই বঞ্চিত করছে না পানির পাওনা থেকে, সে নিজের জন্যও ডেকে আনছে মহাদুর্যোগ। সারা পৃথিবীতে বাঁধ প্রকল্প বর্জন করা হচ্ছে, নদীর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক গতিপ্রবাহে হাত দেওয়ার চিন্তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশকেও সেচের জন্য, বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য, বিদ্যুতের জন্য নদীর গতিপথ ও প্রবাহ বন্ধ করার চিন্তা একেবারেই বাদ দিতে হবে। উত্তরাখন্ডের মহাপ্লাবন সেই শিক্ষাই দিচ্ছে। দেবতার গ্রাস যেমন ভয়াবহ, প্রকৃতির প্রতিশোধও কম ভয়াবহ নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।