
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু ভোলানাথ ও শিশু কাব্যগ্রন্থের মোট ৭৪টি কবিতার মধ্যে মাত্র একটি কবিতা ‘পরিচয়’ মেয়েশিশুকে নিয়ে লেখা। বাকি কবিতাগুলোয় রবিঠাকুর ছেলেশিশু হয়েই সব কবিতার কথক হয়েছেন। এমনকি ‘বিজ্ঞ’ কবিতাটিতে ছোট্ট বোনটাকে বোকাসোকা মেয়ে বলে উল্লেখ করেছেন—
‘খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা, খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ
ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি, আমরা যখন উড়িয়েছিলাম ফানুস’
বিখ্যাত নারী লেখকদের কাছে অনেকেই সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন রাখেন ‘আপনার উপন্যাস সব সময় নারীকেন্দ্রিক। আপনি কি নারীবাদী?’ বেশির ভাগই উত্তর দেন ‘নিজে নারী বলেই নারীর কথা লেখা সহজ’। কেউ নিজেকে নারীবাদী বলেন, কেউ বলেন, না, সমতাবাদী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কি অন্য কারও তুলনা চলে? তাই তাঁর কাছ থেকে আমরা ন্যায্য বিচার আশা করি। কিন্তু তিনিও পুরুষ ছিলেন, তিনিও তো পুরুষের কথাই বেশি জানবেন। তবু যখন তাঁর কাব্য-গানে নারীর প্রেম-বিরহের বাণী মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন তিনি নারীকে বোঝেন না—তা তো মনে হয় না।
জন্মের সময় সবাই শিশু। একমাত্র যৌনাঙ্গ ছাড়া ছেলে ও মেয়েশিশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। কিন্তু বেশির ভাগ মা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন চান প্রথম সন্তানটি যেন ছেলেই হয়। কেন? কারণ পৃথিবীটা পুরুষের। পুরুষই উত্তম। উত্তম পুরুষ। উত্তম নারী বলে ব্যাকরণেও কিছু নেই। পুরুষই পৃথিবী শাসন করে, নারী তার অধস্তন। তাই বলে কি মেয়ে জন্মাবে না? যদি প্রথম মেয়ে জন্মায় তবে পরিবারের সবাই মুখ ভার করে বলে, প্রথম মেয়ে হওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ। যদি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে আলট্রাসনোতে জানা যায় মেয়ে হবে, তাহলে ডাক্তাররাও বলে দেন, সুস্থ একটা বাচ্চাই কাম্য হওয়া উচিত, ছেলে না মেয়ে সেটা বড় কথা নয়। মেয়ে জন্মাবে জানতে পেরে ভ্রূণ হত্যা চলছে দেদার ভারত ও চীনে। আরবে মেয়েশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, আমরা ইতিহাসে পড়েছি। তারপরও মেয়েরা আসছে পৃথিবীতে। সেই মেয়েশিশু আর কেবল শিশু থাকছে না। সে অল্প কয়েক দিনেই নারী হয়ে উঠছেন। দার্শনিক সিমন দ্য বেভোয়ার বলেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে।’
কখন থেকে মেয়েশিশুটির নারী হয়ে ওঠার গোড়াপত্তন হয়? যখন তার হাতে তুলে দেওয়া হয় পুতুল। সে পুতুলকে বুকে নিয়ে দুধ খাওয়ানোর ভান করে, গোসল করায়, ঘুম পাড়ায়, একদিন পুতুলের বিয়ে দেয়। ছেলে পুতুলের মায়েরা ছেলেকে বিয়ে করাতে আনে, মেয়ের বিয়ে হয়। এখনো বিবাহযোগ্য নারীদের বলা হয়, তোমার বিয়ে হয়নি? আর বিবাহযোগ্য পুরুষকে, তুমি বিয়ে করোনি? নারীর বিয়ে হয় আর পুরুষ বিয়ে করে। মেয়ের বাবাকে বলা হয়, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। আর মেয়েশিশুর জন্য খেলনা-পাতিল কিনে দেওয়া হয়। ছোট থেকেই রান্নাবান্না শিখতে থাকুক। বড় হয়ে হাঁড়ি ঠেলা ছাড়া আর কী করবে? ছেলেশিশুর জন্য আনা হয় বল, বন্দুক, মোটর গাড়ি, উড়োজাহাজ। মেয়ে বেশি দুষ্টুমি করলে বলা হয়, মেয়েমানুষের মতো ধীরস্থির হও। ছেলে হুলুস্থুল করলে বলা হয়, পুরুষের মতোই করছে। একটা পরিবারে ছেলে ও মেয়েশিশু পাশাপাশি বড় হলে তারা অভিভাবকদের মানসিকতায় বেড়ে ওঠে। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে যেমন আচরণ করেন, শিশুরাও সেটাই শিখে নেয়। কারণ, মেয়েশিশুটিকে মায়ের মতো মেয়েমানুষ হিসেবে তৈরির যাবতীয় সবক দেওয়া হয়। আর ছেলে দেখে বাবার কী ক্ষমতা! বাবার এক ধমকে সবাই তটস্থ। তার মানে পুরুষই মহাশক্তিধর। ছোট্ট ছেলেটিকে আর নতুন করে শেখাতে হয় না, তুমি পুরুষ হয়ে ওঠো।
নারী হয়ে ওঠাতে তো দোষের কিছু নেই। এযাবৎকাল নারীর জন্যই জীবনচক্র প্রবাহিত। ভবিষ্যতে কী হবে তা জানি না। নারী বলে আত্মশ্লাঘা বোধ করা উচিত সব নারীকেই। কিন্তু যে নারী অন্তর্গতভাবে শক্তিমান, তাঁর বহিরাঙ্গিক অবয়ব দিয়ে তাঁকে শক্তিহীন বিবেচনা করা হয়। তখনই মেয়েশিশুটি নারী হয়ে ওঠে, যখন তাকে বোঝানো হয় তুমি শারীরিকভাবে শক্তিহীন। কারণ, জোর যার মুল্লুক তার। না হয় বুঝলাম, যখন বাহুবলে পৃথিবী শাসিত হতো, তখন নারী যুদ্ধে যেতে পারেননি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে তো মল্লযুদ্ধ বা খোলা ময়দানে তরবারি নিয়ে দুই পক্ষের লড়াই হয় না। এখন যুদ্ধ হয় মেধায় মেধায়। পারমাণবিক মারণাস্ত্রে। যা পরিচালনায় প্রশিক্ষিত নারীর মেধাও সমান কাজে লাগানো যায়। তাহলে মেয়েশিশুকে কেন কিনে দেওয়া হবে পুতুল-হাঁড়ি-কড়াই? কেন মেয়েশিশুকে প্রশংসা করা হয় ‘হোয়াট আ প্রিটি গার্ল!’ আর ছেলেশিশুকে উৎসাহিত করা হয় ‘হোয়াট এ ব্রেভ বয়!’ বলে? মেয়েশিশু তাই আজ মাকে প্রশ্ন করে—
বিকেল হলেই ভাইকে বলো ‘খেলতে মাঠে যা’
আমি কেন ঘরের কোণে হই পুতুলের মা?
ভাইকে বলো সারাক্ষণই বাবার মতো হতে
আমি তবে তোমার মতো চোখ মুছি নিভৃতে?’
ভয় পেয়ে যাই যখন দেখি জি বাংলার সিরিয়ালগুলোয় আজকাল পরিণত তরুণদের সঙ্গে শিশুমেয়েদের প্রেম-বিয়ে-বিরহ-প্রতিহিংসা দেখানো হচ্ছে দেদার। এর কুফল যে দর্শক নারী-পুরুষ বা শিশুদের মনে প্রভাব ফেলবে না, তা কে বলতে পারে? কারণ বাংলার ঘরে ঘরে জি বাংলা এখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এদিকে আমাদের দেশে এখনো মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ বছর করার পাঁয়তারা চলছে। শুধু ১৬ই নয়, প্রয়োজনবোধে তার চেয়ে কমেও বিয়ে দেওয়া যাবে। তার মানে আবারও শিশুতেই নারী হয়ে ওঠার ষড়যন্ত্র। ১৮ হলে যদিওবা অন্তত আরও দুই বছর বেশি শিশু থাকার সুযোগ মিলত, সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন বা শিশু মাতৃত্ব যেখানে সিডও সনদ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতির পরিপন্থী, সেখানে বাল্যবিবাহ কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? বাল্যবিবাহের হার কম দেখানোর জন্য কম বয়সে বিয়েই যদি এ আইনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে অপরদিকে মেয়েশিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন (এখন অনেক মেয়েই উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন দেখে বলে ১৬ বছরের মধ্যে বিয়ে করতে রাজি হয় না। তাদের অমতে বিয়ে দেওয়া মানে জোর করে স্বামীর সঙ্গে যৌন সংসর্গে উৎসাহিত করা (ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ সংসর্গ তো ধর্ষণেরই শামিল)। মাতৃমৃত্যু, প্রসব-পরবর্তী জটিলতা ও শিশুমৃত্যুর হার যে এতে বেড়ে যাবে, সে হিসাব কি করা হয়েছে? তা ছাড়া, এখনো আমাদের দেশে বিয়ের পর মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে না।
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েরা শতকরা ১১ ভাগ এগিয়ে আছে; কিন্তু মাধ্যমিক শেষ হওয়ার আগেই এই ১১ ভাগ ঝরে পড়ে। আর তারপর শুরু হয় পিছিয়ে পড়া। তিনি গবেষণায় দেখেছেন, ঝরে পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪০ ভাগ উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। ইউএনএফপিএর তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের কারণে কলেজে নারীদের অংশগ্রহণের হার অনেক কম। এখনো গড়ে শতকরা ৬৬ ভাগ নারীকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি।
শিশুকে তার শৈশব দিতে হবে। শৈশব হবে নিরপেক্ষ, স্বাধীন, অবাধ ও ভয়হীন। শৈশব থেকেই ছেলেশিশু বা মেয়েশিশুর মনে নারী-পুরুষের সামাজিক পার্থক্য বুঝিয়ে দিলে তাদের চলাফেরার গণ্ডি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসের ছত্রচ্ছায়ায় মেয়েশিশু যেন শৈশব থেকেই হীনম্মন্য হয়ে বেড়ে না ওঠে। মেয়েশিশু নারী হয়ে উঠবে কিন্তু সে নারী পাবে মানুষের সম্মান, অধীনস্থদের চিরকালীন অবদমন নয়।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।