তথ্যপ্রযুক্তি ও মাতৃভাষা

যন্তর-মন্তরে টিকে থাকুক বাংলা ভাষা

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বাঙালিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন রোমান হরফে বাংলা লেখা হয়। বলা বাহুল্য, এ পরামর্শ মেনে নেওয়ার কোনো কারণ বাঙালির ছিল না। ছিল না বলেই আগের চেয়ে হাজার গুণে বড় করে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে, জন্ম হয়েছে ছায়ানটের এবং শুরু হয়েছে পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ আয়োজনের। আর বায়ান্নর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর দাবি ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যার চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ নামে বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যার রাষ্ট্রভাষা হয়েছে বাংলা। তখন থেকেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর একটা চেষ্টা আমাদের রয়েছে, আংশিক সাফল্যসহ। অন্যদিকে মায়ের ভাষার জন্য বাঙালির রক্ত দেওয়ার বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে।
এত কিছুর পরও আজ আইয়ুব খানের কথাটা তুলতে হচ্ছে; কারণ প্রযুক্তি। সেই ষাটের দশকে বাংলা ভাষার জন্য আমাদের যে টান ছিল, তা কি আমরা হারিয়ে ফেলছি? কথাটা আসছে এ জন্য, যে কাজটি আইয়ুব খান গায়ের জোরে চাপিয়ে দিতে পারেননি, তার অনেকখানি এখন হয়ে গেছে প্রযুক্তির কল্যাণে। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠাতে কিংবা ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাৎচিত’ করতে এখন অনেকেই রোমান হরফে অবলীলায় বাংলা লেখেন। কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই লেখেন। এই প্রবণতা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, তবে সেটি সত্য নয়। আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোও এ কাজে যথেষ্ট পারঙ্গম। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রতিনিয়ত মুঠোফোনে অনেক সমাজ-সচেতনতার বার্তা পাঠায়। তার নমুনা: Vitamin ´A´ Jukto Tele, Poribarer Pusti mele. Tai Logo Dekhe Vitamin ´A´ Jukto Tel Kinung- MoI, MoHFW and UNICEF [ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত তেলে, পরিবারের পুষ্টি মেলে। তাই লোগো দেখে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত তেল কিনুন—সংস্থার নাম]। ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ এই খুদে বার্তাটি পেয়েছেন আমার মতো অনেকে। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবসে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো খুদে বার্তা— Betar shobar jonno, shobshomey, sobkhane, aaj (13/02/2014) biswa betar dibosh, 2014.- MOI [বেতার সবার জন্য, সব সময়ে, সবখানে, আজ (১৩/২/২০১৪)বিশ্ব বেতার দিবস]।
সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যখন রোমান হরফে এমন বার্তা পাঠায়, তখন মনে হতে পারে, বাংলা ভাষায় মনে হয় খুদে বার্তা পাঠানোর কোনো পদ্ধতি নেই; মোবাইল ফোনে বা ইন্টারনেটে বাংলায় ‘বাৎচিত’ করা যায় না। কিন্তু, তা মোটেই সত্য নয়। আমাদের তরুণদের প্রচেষ্টায় এসব কারিগরি বাধা আমরা অতিক্রম করেছি অনেক আগেই। সেই আশির দশকে যখন মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাইফুদ্দাহার শহীদ কিংবা মোস্তাফা জব্বার তাঁদের তরুণ বয়সে ছিলেন, তখনই তাঁরা প্রথম কাজটি করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে মোস্তাফা জব্বারের বিজয় সফটওয়্যারটি সেই থেকে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে কম্পিউটারে আর ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। আর ইন্টারনেটের প্রসারের কালে চিকিৎসক-প্রযুক্তিবিদ মেহেদী হাসানের অভ্র সফটওয়্যারটি তরুণদেরও তাঁদের বাংলার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। কেবল কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নয়, বাংলা ভাষাতেই খুদে বার্তা পাঠানো সম্ভব বেশির ভাগ মুঠোফোনে। কিছু পুরোনো মুঠোফোন ছাড়া বেশির ভাগ মুঠোফোনেই বাংলা লেখা ও পড়া সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় সাইট ফেসবুকে এখন অনেকেই মুঠোফোনে বাংলাতেই স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কাজেই কারিগরি ব্যাপারটিকে কেউ যদি সামনে আনতে চান, তাহলে তাঁদের জন্য বসু কণার বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সেই আপ্তবাক্যটি মনে করিয়ে দেওয়া যায়—‘যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।’
অথচ আশ্চর্য হলেও সত্য যে আমাদের নানান সময়ে কম্পিউটারের দোহাই দিয়ে ইংরেজি ভাষায় নানান কিছু করতে বাধ্য করা হয়। যেমন, এখনো অনেক ব্যাংকের হিসাব খুলতে হয় ইংরেজিতে। চেক বইয়ে গ্রাহকের নামটা ইংরেজিতেই মুদ্রিত থাকে। মোবাইল ফোনের বেলায়ও ব্যাপারটি অনেকখানি সত্য। শুধু তা-ই নয়, মোবাইল ফোনের আবেদনের সঙ্গে যে শর্তাবলি থাকে, সেটিও সম্পূর্ণ ইংরেজিতে ছাপা থাকে।
অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বেলায়ও এটি লক্ষ করা যায়। রেডিও, টেলিভিশন, ফোন, রেফ্রিজারেটর কিংবা সে রকম কোনো কিছুর ব্যবহারকারীর ম্যানুয়াল কখনো বাংলায় লেখা দেখিনি। কাজেই এটি ধরে নেওয়া যায় যে যন্ত্রের ম্যানুয়াল না পড়ার যে অভ্যাস আমাদের সংস্কৃতিতে তৈরি হয়েছে, সেটির জন্য ভিন্ন ভাষার নির্দেশিকাগুলো অনেকাংশে দায়ী। অথচ ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার হিসেবে বাংলাদেশ যথেষ্ট বড়। দেশে প্রতি মাসে যে পরিমাণ মোবাইল ফোনসেট বিক্রি হয়, পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। আমার বিশ্বাস, সব নির্মাতাকে একটি মানাযোগ্য নির্দেশনা দিলেই তাঁরা সেই নির্দেশ মানতে কার্পণ্য করবেন না।
তবে, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে কেবল যান্ত্রিক সমস্যা দূর করাই যথেষ্ট নয়। দেশের প্রায় তিন কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বিশ্বের কয়টা দেশের মোট জনসংখ্যা তিন কোটি? মুশকিল হচ্ছে, এদের জন্য ইন্টারনেটে আমাদের মাতৃভাষায় কন্টেন্ট খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের ৬২ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে ৪২ লাখেরই বয়স এখনো ২৫ পেরোয়নি। তার মানে, শেখার আর শেখানোর জগতেই আছেন। তাঁদের জন্য ইন্টারনেটে বাংলা কন্টেন্ট বাড়ানোর সবচেয়ে বড় পন্থা হলো মুক্ত বিশ্বকোষ—উইকিপিডিয়া। উইকিপিডিয়া এমন একটা বিশ্বকোষ, যাতে লিখতে আর সম্পাদনা করতে পারেন সবাই। দরকার সদিচ্ছা।
শুধু তা-ই নয়, দেশের দুটি মোবাইল অপারেটরের সংযোগ থেকে মোবাইলে বিনা খরচে উইকিপিডিয়া পড়াও যায়। তবে বিনা মূল্যের এই সার্ভিসটা আমাদের শিক্ষার্থীদের সেই অর্থে কাজে লাগবে না, যদি আমরা বাংলা কন্টেন্ট না বানাই। বাংলা উইকিপিডিয়াকে (bn.wikipedia.org) সমৃদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করছেন অনেকেই। ২০০৬ সাল থেকে আমরা বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই কাজটা করার চেষ্টা করেছি। আর ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ, যা উইকিপিডিয়ার নেপথ্য সংগঠন উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। দেশে বা দেশের বাইরে যাঁরা বিনা মূল্যের মুক্ত বিশ্বকোষ সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। সময় পেলেই তাঁরা বিশ্বকোষে কোনো না কোনো তথ্য যোগ করেন। অন্যদের জানানোর জন্য প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বইমেলার সামনে ব্যানার নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন। সম্ভব হলে বিভিন্ন স্থানে সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করেন।
তবে, তাঁদের পক্ষে একা এই মহাযজ্ঞটিকে একটি স্থানে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। ১৯৫২ আর ১৯৬২-এর স্পিরিটকে বুকে ধারণ করে চলুন আমরা সবাই মিলে বাংলা ভাষায় একটা মুক্ত জ্ঞানভান্ডার গড়ে তুলি। এর জন্য আপনার-আমার কোনো টাকা-পয়সাই লাগবে না। দরকার কেবল সদিচ্ছা। আর দরকার বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা।

মুনির হাসান: যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো। সভাপতি, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ।