
রোজাদারদের মন থেকে সব ধরনের লোভ-লালসা ও হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সমাজে সবার সঙ্গে শান্তিতে মিলেমিশে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। রোজা পালন বা সিয়াম সাধনা শুধু উপবাসের নামান্তর নয়, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাপক, গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সংযমই রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য। রোজা হচ্ছে আত্মশুদ্ধির উন্নত ও পরিশীলিত সোপান। পার্থিব যাবতীয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংযম ও তাকওয়া বা পরহেজগারি অর্জনের নামই হলো রোজা। এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা কোরো না।’ (সূরা আল-নিসা, আয়াত-৩২)
রোজার মাধ্যমে মানুষকে জাগতিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, ফেতনা-ফ্যাসাদ, পরচর্চা-পরনিন্দা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করার এবং উন্নততর আদর্শের অনুসারী হওয়ার অপূর্ব সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। লোভ-লালসা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও জুলুমের দিকে ধাবিত করছে। তাই রোজাদার বান্দার মূল লক্ষ্য থাকবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ধনসম্পদ, মানসম্মান, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি লোভ-লালসা দ্বীন ইসলাম ও ইমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাসুলুল্লাহ (সা.) লোভ-লালসাকে সর্বদা দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ইমান এবং লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না। কেননা, ইমানের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা ও অল্পে তুষ্ট থাকা। আর লোভ-লালসার পরিণাম হচ্ছে অশান্তি, ধৈর্যহীনতা ও অস্বস্তিবোধ।’ (নাসাঈ ও তিরমিজি)
রোজা দেহের জাকাতস্বরূপ, জাকাত আদায় করলে যেমন সমস্ত সম্পদ পবিত্র হয়ে যায়, তেমনি রোজা রাখলে সমস্ত শরীর পবিত্র হয়ে যায়। হাদিস শরিফে রোজাকে ইবাদতের দরজা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজা মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ যতক্ষণ না সেই ঢালকে কেউ বিনষ্ট করে ফেলে, আর মিথ্যা ও পরনিন্দা দ্বারা এ ঢাল বিনষ্ট হয় বা এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে যায়।’ সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি যদি লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, অসৎ কাজ প্রভৃতি পাপাচার থেকে আত্মরক্ষা করে থাকেন, তবেই রোজা শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের কারণ হতে পারে।
রোজা পালনকারী ব্যক্তির যেকোনো নেক দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। যিনি সিয়াম সাধনায় রত, তিনি কেবল আল্লাহর প্রেমে বিমুগ্ধ হয়ে রোজা পালন করছেন। রোজাদারের সব প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে গ্রহণ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের নির্দেশ দান করেন, তোমাদের নিজস্ব ইবাদত মুলতবি রাখো এবং রোজাদারদের দোয়ার সময় আমিন বলতে থাকো।’ কিন্তু লোভ-লালসা ও হিংসা-বিদ্বেষকারী লোক তওবা করে নিজ নিজ বদ কার্যাদি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাদের ক্ষমা করেন না।
ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ দৈহিক ইবাদত। জাগতিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ দমনসহ মানুষের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শক্তি-সামর্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রেও রোজা এক অসাধারণ কার্যকর ব্যবস্থা। নানা প্রকার লোভনীয় ও অনিষ্টকর উপাদান সঞ্চিত হয়ে মানুষের দৈহিক শক্তি শিথিল করে দেয়। রোজার মাধ্যমে সেগুলো অপসারিত হয়। অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ প্রেরণা ও চেতনা অনুভূতির ওপর রোজার প্রভাব অপরিসীম। এ জন্য রোজা যেমন কল্যাণকর, তেমনি সদাচার ও নেক আমল অর্জন করার জন্যও বিশেষ সহায়ক। পবিত্র কোরআনে যেসব বস্তু থেকে মহান আল্লাহর দরবারে পানাহ চাওয়ার তাগিদ রয়েছে, তার মধ্যে হিংসা অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে (পানাহ চাই), যখন সে হিংসা করে।’ (সূরা আল-ফালাক, আয়াত: ৫)
রোজাদারদের লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত। কেউ তাকে মন্দ গালি দিলেও অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে উদ্যত হলেও পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া উচিত যে ভাই! আমি রোজা রেখেছি, তোমার সাথে এ অন্যায় কাজে আমি যোগ দিতে পারব না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারগণ বিশেষ একটি দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন, এর নাম ‘রাইয়্যান’ বা তৃপ্তিদায়ক। সব রোজাদার প্রবেশ করার পর সে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর আর কেউ এ দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।’ অপর এক বর্ণনানুযায়ী ‘রাইয়্যান দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি কখনো পিপাসার কষ্ট অনুভব করবে না।’ (তিরমিজি)
রোজার মাধ্যমে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে রোজাদার বান্দারা অতিমানবীয় জীবনের দীক্ষা নেন। যাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পার্থিব কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাপরায়ণতা ও পরশ্রীকাতরতা পরিহার করে রোজার যথার্থ তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেন, সেই রোজাদারদের আল্লাহ তাআলা তাঁর অপার করুণা, ক্ষমাশীলতায় জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের তাওফিক দান করেন। সুতরাং লোভ-লালসা সংবরণ করুন; হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলুন। ব্যক্তিগত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক লোভ-লালসা, জাগতিক হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আর্তমানবতার কল্যাণে নিজের মানবিকতা জাগিয়ে তুলুন। তাহলে সমাজ থেকে লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা দূর হয়ে উত্তম চরিত্রের গুণাবলির প্রকাশ ঘটবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্ম বিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com