কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।

মতামত

না, ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়

মাত্র কদিন আগেই বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোডেইলি স্টার-এ আমার দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের মুহূর্তে তাজউদ্দীন আহমদের উচ্চারিত এক দূরদর্শী সতর্কবাণী নিয়ে।

চারদিকে যখন বিজয়ের উল্লাস, তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী গভীর উদ্বেগে বলেছিলেন ‘এই দেশটা কি মানুষের বসবাসযোগ্য হবে?’

প্রবন্ধটি প্রকাশের দুদিনের মাথায় আবারও যেন সেই প্রশ্নের উত্তর মিলল এক নির্মম বাস্তবতায়।

প্রথম আলোডেইলি স্টার-এর অফিসে আগুন জ্বলল দাউ দাউ করে। ছায়ানট, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, উদীচীসহ বহু সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হলো পরিকল্পিত তাণ্ডবে।

বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবনের অবশিষ্টাংশের ওপর চালানো হলো তৃতীয় দফা বুলডোজার হামলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতোই ছিল নীরব দর্শক।

আততায়ীর গুলিতে আহত আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন বৃহস্পতিবার।

আর সেই রাতেই ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিককে কথিত ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে, বিবস্ত্র করে গাছে ঝুলিয়ে, তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও ক্রন্দনরত পিতার সামনে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর একটি শিশুসন্তানও রয়েছে।

প্রশ্ন জাগে—রাষ্ট্র কি এই পরিবারের দায়িত্ব নেবে? অপরাধীদের কি আইনের আওতায় আনা হবে?

এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এগুলো একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ, যার লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করা এবং একটি সহিংস, বিভাজনমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা।

দীর্ঘদিন ধরেই প্রগতিশীল সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ বলে অপবাদ দিয়ে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তারা যদি সত্যিই এজেন্ট হয়, তবে তার প্রমাণ কোথায়?

প্রমাণ থাকলে তা যাচাই ও বিচার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, আইনের। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সন্ত্রাস চালানোর অধিকার নেই।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার আমলে একের পর এক মিথ্যা মামলা করা হয়েছিল।

প্রথম আলোডেইলি স্টার পত্রিকা দুটিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেভাবে এই সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন।

ধ্বংসযজ্ঞে এতটাই ক্ষতি হয়েছিল যে প্রকাশনার ইতিহাসে দুটো পত্রিকাই প্রথমবারের মতো পরদিন পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেনি।

একটি সহনশীল, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বিচারব্যবস্থা হবে নিরপেক্ষ, এবং রাষ্ট্র হবে নাগরিকের আশ্রয়স্থল, আতঙ্কের উৎস নয়।

বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, পারিবারিককরণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করেছে।

একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দলগুলোর উত্থান, অন্যদিকে ভারতে অবস্থানকারী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সমর্থকদের দেশের স্বার্থবিরোধী অপতৎপরতা—এই দুই মিলে দেশে যে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা দমন করে জনগনের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভেতর যখন দুর্বল হয় তখন বাইরের বিভিন্ন শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে।

আজ, এই সংকটময় সময়ে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে একটি সহনশীল, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বিচারব্যবস্থা হবে নিরপেক্ষ, এবং রাষ্ট্র হবে নাগরিকের আশ্রয়স্থল, আতঙ্কের উৎস নয়।

তাজউদ্দীন আহমদের সেই প্রশ্ন ‘এই দেশটা কি মানুষের বাসযোগ্য হবে?’—আজও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই দিতে হবে, আমাদের নৈতিকতা, সাহস ও ঐক্যের মাধ্যমে।

  • শারমিন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে ও লেখক।