
কমরেড অজয় রায় ছিলেন একাধারে রাজনীতিক, লেখক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে।
মৃত্যু ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর। প্রায় ৮৮ বছরের জীবনে তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি আমাদের সমাজের ভেতরের মনোজগৎ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। কেবল দেশভাগ নয়, আরও পেছনে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে এ দেশ থেকে হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তের একাংশ ভারতে চলে যায়। আবার ভারতে মুসলিম মধ্যবিত্তের একাংশ পূর্ববঙ্গে চলে আসে। কিন্তু বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক প্রমথ রায়ের পুত্র অজয় রায় ১৯৪৪ সালেই বারানসি ছেড়ে জন্মভূমি কিশোরগঞ্জে চলে আসেন। দেশভাগের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তাঁকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।
অজয় রায়ের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রাবস্থায়। অন্যান্য বামপন্থীর মতো তিনিও পাকিস্তান আমলের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। ১৯৬৭ সালে কারাগারে বসেই তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। আবার এই কারাজীবন তাঁর নিরবচ্ছিন্ন পঠন-পাঠন এবং লেখার সুযোগ এনে দেয়। অজয় রায় ছিলেন লেখক–রাজনীতিক সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের সহযাত্রী। সত্যেন সেনই তাঁকে লেখালেখির বিষয়ে উৎসাহিত করেন।
কারাগারে বসেই অজয় রায় লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই বাঙলা ও বাঙালী। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে এ ধরনের গবেষণাধর্মী কাজ করার উদাহরণ খুব বেশি নেই। উনসত্তরের মার্চে গণ-আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা তাঁকে ময়মনসিংহ কারাগার থেকে বের করে। একজন রাজনীতিকের জন্য এটি বড় পাওনাও বটে।
বাঙলা ও বাঙালী বইয়ে অজয় রায় বাঙালির স্বরূপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এর সীমানা, প্রকৃতি, নদ-নদীর বিবরণ তুলে ধরেছেন, বাঙালির খাদ্য, বসন-ভূষণ, প্রসাধন, প্রথা, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছেন। বইটি সহজ–সরল ভাষায় লেখা। এ কারণে জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
বাঙলা ও বাঙালী বইয়ের ভূমিকায় শিক্ষাবিদ আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘লেখক বাঙালির সুচির কালের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং তার প্রয়াস অনেকাংশে সফল ও সার্থক হয়েছে বলেই মনে করি। আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিবৃত্ত আজো প্রায় অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেছে। এ গ্রন্থের লেখক অদ্যাবধি আবিষ্কৃতি ও অনুমিত তথ্য-তত্ত্বের স্বাধীন প্রয়োগে রচনা করেছেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে উৎসুক ও জিজ্ঞাসু বাঙালীর আত্মদর্শন হবে।’
অজয় রায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন এবং স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পার্টিতে থাকেননি। ‘বাংলাদেশের বাম আন্দোলনের সমস্যাবলী’ প্রবন্ধে তিনি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সবখানেই দেখেছি সমাজ শ্রেণিবিভাগ বিলোপ করার দিকে এ নিয়ে কাজের বদলে সমাজে নতুন করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও শ্রেণি বিভাজনপ্রক্রিয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রে। আর তারই অনুষঙ্গরূপে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রসঙ্গে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে বৈষম্য দৃষ্টিকটুরূপে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
অজয় রায় ও তাঁর সতীর্থরা আজীবন এই বৈষম্য বিলোপেরই রাজনীতি করেছেন। তাঁরা এ-ও বলেছেন যে ভুল প্রয়োগের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে না থাকার অর্থ সমাজতান্ত্রিক
দর্শনের অসারতা নয়।Ä মার্ক্সবাদের মূল কথা
যে ‘মানুষের মুক্তি’ এবং তার পক্ষে দেশে দেশে যুগে যুগে মানুষ লড়াই করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
তাঁর মতে, ‘এ দেশের বামপন্থী আন্দোলনের আরেকটি সমস্যা আমার বিবেচনায় আদর্শগত সংঘাতের কাজে বাস্তব কোনো অবস্থা গুরুত্ব
না দেওয়া।’ অনেক আগেই তিনি আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ ও বাঙালিকে যদি বিশ্বসভায় তার যথাযোগ্য স্থান নির্দিষ্ট
করতে হয়, তাহলে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে, তেমনি একই সঙ্গে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে তার বিশ্লেষণধর্মী অতীতকে।’
অজয় রায় বাংলাদেশ পরিসরে সাম্প্রদায়িক পুনর্জাগরণ রোধ বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেছেন। সে কারণে সামাজিক আন্দোলন করেছেন, ধর্মীয় ভেদনীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। সমাজের সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন, শুধু রাজনৈতিক সংগ্রাম দিয়ে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
আনা যাবে না; সেটা আনতে হলে সমাজের ভেতরকার ক্লেদ ও বিভেদ দূর করতে হবে। সমস্যাটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, গোটা সমাজের ওপর-নিচতলারও। কেননা ‘বাংলাদেশে জাতিসত্তার পর্যায় এখনো পরিপূর্ণ হয়নি।
সে অধ্যায় অতিক্রম না করে উচ্চতর পর্যায়ে পা রাখা সম্ভব না।’
অজয় রায় চেয়েছিলেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আদর্শনিষ্ঠা বহুনৈতিক শক্তির উপস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনে রাজনৈতিক ও সমাজশক্তির মেলবন্ধন। তাঁর অন্য উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, রাজনীতির অ আ ক খ, গণ-আন্দোলনের এক দশক ও বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন। তাঁর এসব বই ও জীবনাদর্শ উত্তর প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
চলতি বছর লেনিনের রাশিয়া তো বটেই, সারা বিশ্বেই অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্যাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে জাতীয় কমিটির বছরব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন বাম দল ও সংগঠন নানামুখী কর্মসূচি নিয়েছে। অজয় রায় বেঁচে থাকলে তিনিও এর অংশীজন হতেন।
প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
l সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।