Thank you for trying Sticky AMP!!

আমেরিকায় বামপন্থীরা জাগছেন

আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেস

মাত্র ২৯ বছর বয়স মেয়েটির। নাম আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেস। মার্কিন কংগ্রেসের কনিষ্ঠতম সদস্য, দীর্ঘদিনের পুরোনো এক ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যানকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা চান। রাখঢাক ছাড়াই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। তাঁকে এ জন্য উপহাস করা হবে—এ কথা জেনেও।

আলেকজান্দ্রিয়াই যে মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম সমাজতন্ত্রী, তা নয়। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন যদিও কখনো নিজের নামের আগে সমাজতন্ত্রী শব্দটি ব্যবহার করেননি, তাঁর কথায় সমাজতান্ত্রিক ধারণার স্পষ্ট প্রকাশ রয়েছে। স্যান্ডার্স, ওয়ারেন ও কর্তেস—এঁরা প্রত্যেকেই মনে করেন, আমেরিকায় যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা শুধু দেশের ১ শতাংশ ধনীর পক্ষে কাজ করছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরিবরা আরও গরিব। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমূল না ভেঙেই এই ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

স্যান্ডার্স ও ওয়ারেন মূলত চলতি আইন পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তাঁরা বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন নির্বাচনী ব্যবস্থা ও আর্থিক সংস্থাসমূহের ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ওপর। আলেকজান্দ্রিয়া তাঁদের সঙ্গে একমত, কিন্তু তাঁর বিশেষ আগ্রহ সব ক্ষেত্রে নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির প্রতি। তাঁর কথায়, ‘আমি চাই সবার মানসম্পন্ন শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, কর্মের অধিকার। কারও বর্ণ, ধর্ম বা আর্থিক মর্যাদা দ্বারা এই অধিকার নিয়ন্ত্রিত হবে না।’

স্যান্ডার্স থেকে কর্তেস—প্রত্যেকেই নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়াতে চান। তাঁরা প্রস্তাব করেছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চাই। প্রতিটি মানুষ যাতে একই মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য–সুবিধা পায়, সে জন্য এই দুই খাতের ওপর ব্যক্তিগত খাতের প্রভাব কমিয়ে রাষ্ট্রীয় খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কর্তসে ও কংগ্রেসে তাঁর সমমনা সদস্যরা জলবায়ু–সংকট রোধের লক্ষ্যে সম্প্রতি এক নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে পুরোপুরি ‘সবুজ’ করার মাধ্যমে ক্ষতিকর কার্বন গ্যাসের প্রভাব ঠেকানো। মার্কিন অবকাঠামো ঢেলে সাজানো ও পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোয় সক্ষম মজুরির দাবিও এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির যেসব সদস্য ২০২০ সালে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই এই ‘নিউ গ্রিন ডিল’ সমর্থন করেছেন।

বলা বাহুল্য, করপোরেট আমেরিকা ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখেনি। যাকে আমরা মূলধারার তথ্যমাধ্যম বলি, তারাও ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। তবে ব্যাপারটা যে হাসির নয়, সে কথার স্বীকৃতি মিলেছে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা থেকে। এই মাসের গোড়ায় তাঁর স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে তিনি সমাজতন্ত্রের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। ‘এখানে কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের কথা বলা শুরু করেছেন, তাঁদের এইসব কথাবার্তা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমেরিকা কখনো সমাজতান্ত্রিক হবে না।’ তিনি কর্তেজের নাম উচ্চারণ করেননি, কিন্তু কথাটা যে তাঁকে উদ্দেশ করেই বলা, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

আমেরিকা রাতারাতি সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করছে, এ কথা কেউ বলে না। ট্রাম্প বা দক্ষিণপন্থী নেতারা যে তেমন ইঙ্গিত করছেন, তার কারণ এ দেশের জনগণের মনে তাঁরা ভীতির সঞ্চার করতে চান। তাঁদের রাজনীতির কেন্দ্রেই রয়েছে ভীতি—বিদেশিদের ভীতি, ভিন্ন ধর্মে ভীতি, সমাজতন্ত্রে ভীতি।

তবে এ কথায় ভুল নেই যে, মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে বামপন্থী প্রবণতা বাড়ছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা যে এখন তথাকথিত ১ শতাংশের বিরুদ্ধে সুর তুলেছেন, তার কারণই হলো আমেরিকান জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মানুষ চলতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফায়দা পাচ্ছে না। যে ১ শতাংশ লোকের হাতে এখন দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ, তারা শুধু অর্থনীতি নয়, নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। আলেকজান্দ্রিয়া ও তাঁর বামপন্থী বন্ধুরা এই অবস্থার পরিবর্তন চান। একে যদি সমাজতন্ত্র বলা হয়, তাতে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।

২.

বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে একটি মৌলিক নীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও সেটি ছিল একটি প্রধান স্তম্ভ। অথচ আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের দাবি শোনা যায় না। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনো প্রধান দলের অর্থপূর্ণ কর্মসূচি নেই। বামপন্থী দলগুলো অবশ্য যথারীতি সমাজতন্ত্রের দাবি তুলে যাচ্ছে, কিন্তু তারা রাজনৈতিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের প্রাসঙ্গিকতাও অনেক কমেছে। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কথার প্রতিফলন।

২৯ বছরের এক নারী, যিনি রাজনীতিতে একজন নবিশ, তিনি আমেরিকায় যে কাজ করতে সক্ষম হলেন, আমাদের ঘাগু বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা তার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছেন না কেন?

এর উত্তর আমাদের বিগত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে পেতে হবে। অর্ধশতক আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। এই প্রভাব আইনসভার ভেতরে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল তার বাইরে। আমাদের প্রায় প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনের অ্যাজেন্ডাই নির্মিত হতো বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। একাত্তরে যে আমরা সমাজতন্ত্রকে একটি মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করি, তার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এমন বামপন্থী দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

১৯৯০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং তারও আগে চীনের আদর্শিক ডিগবাজির পর বিশ্বের সর্বত্রই বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে সংকট সৃষ্টি হয়। আমরাও তার শিকার। আমাদের অন্য সমস্যাও ছিল। স্বাধীনতার পর নিজেদের রাজনৈতিক আন্দোলন সংহত করার বদলে বামপন্থীরা নিজেদের ক্ষমতার রাজনীতির অংশীদার করে ফেলেন। ফলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাঁরা নিজেদের নীতিগত উচ্চাসন হারিয়ে ফেলেন। বামপন্থী আন্দোলনের অন্য ব্যর্থতা, একটি প্রকৃত বামপন্থী কর্মসূচির পক্ষে ব্যাপক রাজনৈতিক জোট গঠনে অক্ষমতা। পৃথিবীর সর্বত্র বামপন্থী আন্দোলন চিরকালই শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আমাদের দেশে এই দুইয়েরই কোনো কার্যকর অস্তিত্ব নেই।

বামপন্থী দল না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন নেই, এ কথা ভুল। রক্তচোষা পুঁজিপতি ছাড়া বৈষম্যবিহীন সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা সমর্থন না করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। কিন্তু সে জন্য ঠিক কী ধরনের সমাজব্যবস্থা চাই, তার রূপরেখাটি স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে আমরা আলেকজান্দ্রিয়া কর্তেসের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। নিউইয়র্ক সিটির ব্রংক্স এলাকার এক কর্মজীবী পরিবারের এই মেয়েটি উঠে এসেছেন স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি সংগঠনের ভেতর দিয়ে। তিনি কী চান, সে কথাটি বোধগম্য ভাষায় প্রকাশে সক্ষম হয়েছেন, ফলে মানুষকে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছেন। তিনি জানেন, ধনতন্ত্রকে পরাজিত করার আগে মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হবে। নিউইয়র্কে তাঁর আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রত্যেক শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন বাড়ানো। আমেরিকার অনেক অঙ্গরাজ্যেই এই দাবির পক্ষে সমর্থন মিলেছে। নিউইয়র্ক ও নিউ জার্সির মতো রাজ্যে এই দাবি সমর্থন করে আইনও পাস হয়েছে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি