হিন্দু পারিবারিক আইন

আসুন, সবাই মিলে ভাবি

বছর দুয়েক আগে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন বিষয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন ভালো কথা, কিন্তু ঘরের ভেতরে যে বৈষম্য রয়েছে, তা নিয়ে কথা বলছেন না কেন?’ সেদিন বলেছিলাম, অর্পিত সম্পত্তি সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হলেই আমরা এ নিয়ে  দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হব। সেদিন বুঝেছিলাম, তিনি হিন্দু আইনে পরিচালিত নারীদের অধিকার নিয়ে ভাবছেন।

প্রধানমন্ত্রী সেদিন যা ঘরোয়া বৈঠকে বলেছিলেন, এবার তা খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন গণভবনে জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে। তিনি হিন্দুসম্প্রদায়ের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যদি একতাবদ্ধ হয়ে উত্তরাধিকার আইন করতে চান, আপনারা মিলিতভাবে আইনের খসড়া করে দেবেন, যেহেতু আপনাদের ধর্ম। আমরা এটা পাস করে দেব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা আপনাদেরই করতে হবে।’ এর অগে প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হিন্দু নারীদের অধিকার প্রদানে সবাইকে ভাববার অনুরোধ জানান।

মনে পড়ে, প্রায় তিন দশক আগে ১৯৮৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের এক আলোচনা সভায়  বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য হিন্দু আইন সংস্কারসম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। আইনের কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনায় স্থান পায়। যার মধ্যে ছিল ক. বহুবিবাহ, খ. অসবর্ণ বিবাহ, গ. পৃথক বসবাস ও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, ঘ. ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব, ঙ. বিবাহে নিষিদ্ধ আত্মীয় গোষ্ঠী, চ. বিবাহ নিবন্ধীকরণ, ছ. নির্ভরশীলদের ভরণপোষণ, জ. কন্যার উত্তরাধিকার, ঝ. জীবনস্বত্ব পূর্ণস্বত্বে রূপান্তরকরণ, ঞ. পুত্র-কন্যার সম-অধিকার, ট. দত্তক গ্রহণ,
ঠ. ধর্মমন্দির দেবোত্তর সম্পত্তি প্রসঙ্গ। আলোচনায় সমাজ ও আইনবিষয়ক ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষণের এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব হয়েছিল।

কিন্তু দুঃখজনক হলো, পরবর্তী রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা আর বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে তা হিন্দুসমাজের একাংশের বিরোধিতার মুখে পড়ে। কেউ কেউ এর মধ্যে বৈদিক ঋষিদের আদর্শ উচ্ছেদের চক্রান্ত দেখেছেন। কেউ–বা আইনের কোনোরূপ পরিবর্তন ‘মানি না মানব না’ স্লোগান তোলে। এই বিরোধিতার
মুখেও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে; তবে তা বাধ্যতামূলক নয়, ঐচ্ছিক। নিঃসন্দেহে এ আইন হিন্দু নারীদের অধিকার রক্ষায় এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। অনেকেই হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন বাধ্যতামূলক করার কথা বলছেন।

বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনের আওতায় নারীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার ন্যায়ানুগ সমাধান প্রয়োজন। এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি:

১.

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন যেহেতু ব্যক্তিগত আইন, বিধিবদ্ধ আইন নয়, তাই তা সংশোধনের আবশ্যকতা নেই। তবে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার আইন, ১৯৩৭-এর প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ কিছু আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক।

২.

হিন্দু বিধবাদের স্বামী, শ্বশুর ও শ্বশুরের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার সৃষ্টি করে ১৯৩৭ সালে হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট
প্রণীত হলেও তা সংশ্লিষ্ট সময়ের নিয়মানুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণীত আইন। কিন্তু তদানীন্তন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার ওই আইন অবলম্বনে কোনো আইন প্রণয়ন না করায় কৃষি সম্পত্তিতে বিধবাদের অধিকার সৃষ্টি হয়নি। অকৃষি সম্পত্তিতেও তঁাদের জীবনস্বত্বে
অধিকার আছে মাত্র। যুগের প্রয়োজনে বিধবা নারীদের জীবনস্বত্বের স্থলে অকৃষি সম্পত্তিসহ কৃষি সম্পত্তিতেও পুত্রের সমপরিমাণ উত্তরাধিকারিত্ব নিশ্চিতের বিধান করে আইনি সংশোধন প্রয়োজন।

৩.

কোনো হিন্দু স্ত্রী-পুত্র ছাড়াও পিতা-মাতা রেখে মারা গেলে উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্রের পাশাপাশি পুত্রের অবস্থানে তার পিতা-মাতারও উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।

৪.

পিতা-মাতার ত্যাগ করা সম্পত্তিতে কন্যাকে এক পুত্রের সমান অর্ধাংশের ভোগদখলের অধিকারী করে আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক, যাতে বিয়ের প্রয়োজনে ওই সম্পত্তিতে থাকা তার অংশবিশেষ বিক্রি করে বিয়ের ব্যয় নির্বাহ করা যেতে পারে। তবে শর্ত থাকে যে, বিয়েতে ব্যয় নির্বাহের পর সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকলে তা ভাইয়ের বরাবরে ন্যস্ত হবে এবং বিয়ে অবশ্যই হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রীয় বিধিবিধানমতে স্বসম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পন্ন হতে হবে। কন্যার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত পুত্র কোনোভাবে তার অংশ হস্তান্তর করতে পারবে না। পিতা-মাতার যথাযথ ত্যাগ করা বিত্ত না থাকলে সে ক্ষেত্রে অবিবাহিত বোনেরা ভরণপোষণ ও বিয়ের ব্যয় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী হবে।

৫.

বিদ্যমান হিন্দু আইনে পুত্রহীন মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে ওয়ারিশ হওয়ার ব্যবস্থা নেই, আছে পুত্রবতীদের। যুগের প্রয়োজনে পুত্রবতীদের পাশাপাশি পুত্রহীনা মায়েদেরও একই রূপ অধিকার থাকা আবশ্যক। অধিকন্তু প্রচলিত হিন্দু আইনে যে ক্ষেত্রে কন্যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জন করে, সে ক্ষেত্রে একাধিক কন্যার মধ্যে একজন মারা গেলে মৃত কন্যার পুত্র বা মূল মালিকের দৌহিত্রেরা সঙ্গে সঙ্গে মাতার অংশের ওয়ারিশ যাতে হতে পারে, তার জন্যও আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক।

৬.

হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার স্বত্ব পিণ্ডদানের অধিকারভিত্তিক। ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি পিতা, মাতা বা পূর্বপুরুষদের পিণ্ডদানের অধিকার হারান। শাস্ত্রীয় আইনে ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার ব্যবস্থা দ্য কাস্ট ডিজএবিলিটিস রিমুভাল অ্যাক্ট মূলে অবসান হয়। হিন্দুধর্মের মৌলিক বিষয় এবং বর্তমান সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এ আইন বাতিল করে পূর্বেকার শাস্ত্রীয় আইন চালু করা অত্যাবশ্যক।

৭.

হিন্দু আইনে দত্তক গ্রহণে পালক পুত্রের ব্যবস্থা থাকলেও রেজিস্ট্রি দলিলের বাধ্যবাধকতা নেই, যা আবশ্যক। তাই দত্তকপুত্রের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি দলিলের বাধ্যবাধকতার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন আবশ্যক।

৮.

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখা অসম্ভব, সে ক্ষেত্রে পৃথক বসবাসের চুক্তিতে অনেকে অবদ্ধ হয়। অনেকে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। স্ত্রীর পৃথক বসবাসের পাশাপাশি তঁার ভরণপোষণের, বাসস্থানের ব্যবস্থা পাওয়ার জন্য হিন্দু স্ত্রীর ভরণপোষণ ও পৃথক বসবাস আইন ১৯৪৬ প্রচলিত থাকলে তাতে সব সময় সমস্যার সমাধান হয় না। অপরদিকে বিদ্যমান হিন্দু আইনে পুরুষের একাধিক বিয়ের সুযোগ থাকলেও স্ত্রীর পক্ষে এক স্বামী রেখে তাঁর সঙ্গে পৃথক বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করেও দ্বিতীয় বিয়ে সম্ভব নয়। এসব সমস্যার সমাধানে ভারতে ১৯৫৫ সালে প্রণীত হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের অনুকরণে পারিবারিক আদালতে আশ্রয় গ্রহণে প্রার্থীর আবেদনে আনীত অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদের বা ক্ষেত্রবিশেষে বিবাহ বাতিল ঘোষণার বা আপসে বিচ্ছেদের (mutual divorce) প্রতিকারের সুযোগ সৃষ্টি করে আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। তবে শর্ত থাকে যে স্বামী যদি বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করেন, তবে বিচ্ছেদ সত্ত্বেও মহিলার দ্বিতীয় বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তঁার ভরণপোষণ ও বাসস্থানের দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তাতে হবে। আর স্বামীর নির্যাতন ও অত্যাচারে স্ত্রী যদি বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর পুনর্বার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বা স্ত্রীর আমৃত্যু ভরণপোষণ, বাসস্থানের ব্যয় স্বামীকে বহন করতে হবে।

৯.

প্রচলিত হিন্দু আইনে হিন্দু পুরুষের স্ত্রী থাকাবস্থায় একের অধিক বিয়েতে বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকাবস্থায় স্বামী যাতে স্ত্রীর লিখিত অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে না পারেন, সে জন্য আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। এ আইনে স্ত্রীর অমতে বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে।

১০.

প্রচলিত হিন্দু আইনে উইল রেজিস্ট্রিযুক্ত হলেও প্রবেটনেওয়া আবশ্যক। অথচ মুসলিমদের ক্ষেত্রে আবশ্যকতা নেই। সে ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান সাকশেসন অ্যাক্টের প্রয়োজনীয় সংশোধনক্রমে মুসলিমদের অনুরূপ হিন্দুদের ক্ষেত্রেও উইল রেজিস্ট্রিযুক্ত হলেই তার
প্রবেট নেওয়া অনাবশ্যক ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক।

এসব প্রস্তাব আমার ব্যক্তিগত নয়। ২০০৮  সালে ধর্ম মন্ত্রণালয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সহজীকরণের জন্য সুপারিশ চেয়ে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ হিন্দু ফাউন্ডেশনের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। তারই আলোকে দফায় দফায় আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন স্থানীয় বিশিষ্ট আইনবিদ, ধর্মীয় পণ্ডিত ও বিভিন্ন স্তরের সামাজিক ব্যক্তি। এতে উল্লিখিত সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়।

আসুন, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান নিয়ে আমরা সবাই মিলে ভাবি। দেশজ-কালজ সামগ্রিক পরিবেশ–পরিস্থিতি বিবেচনায় হিন্দু আইনে পরিচালিত নারীদের অসহায়ত্ব থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে আমাদেরই। মনে রাখা দরকার, সমাজবাস্তবতায় পুরোনো আইনের ফসিলের ওপর নতুন আইনের ভিত রচিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।

রানা দাশগুপ্ত: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ।