অরণ্যে রোদন

কদিনের ছুটি ন দিনে ছুটি

ঈ​েদর ছুটি মানেই অনেকের কাছে বাড়ি যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়া
ঈ​েদর ছুটি মানেই অনেকের কাছে বাড়ি যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়া

আসলে এভাবে কি কাজ হয়! আমরা কি অফিস-আদালতে শুধু কাজই করি? নাকি আমরা কাজ করি বাসায় আর অফিসটাকে ব্যবহার করি অবসর, বিনোদন আর জনসংযোগের একটা সুযোগ হিসেবে? ঢালাওভাবে নিশ্চয়ই কোনো কথা বলা যাবে না, রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ কি রোদে কি বৃষ্টিতে যানজট সামলানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন, ব্যাংকের কাউন্টারে বসা কর্মী একবারও মাথা না তুলে কাজ করে চলেছেন, এ রকম দৃশ্য আমাদের সবারই চোখে পড়ে। কিন্তু সেই যে কৌতুক প্রচলিত আছে, সাহেব অফিসে যান, কোটটা চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখেন, তারপর বেরিয়ে পড়েন নিজের কাজে। তাঁর কত কাজ। তাঁকে ইউনিয়ন করতে হয়, দেশোদ্ধার করতে হয়! বস এক কর্মীকে বললেন, আপনি নাকি রোজ দেরি করে অফিসে আসেন? কর্মচারী জবাব দিলেন, আপনি শুধু আমার আসাটা দেখলেন, যাওয়াটা দেখবেন না, আমি রোজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে যাই। কর্তার একই প্রশ্নে আরেক কর্মচারী জবাব দিয়েছিলেন, ‘স্যার, আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়।’ তখন বস আকাশ থেকে পড়লেন, ‘সে কী, আপনি কি বাড়িতেও ঘুমান!’

অবশ্যই আমাদের অফিস-আদালতে কাজ হয়। আমাদের এক সরকারি কর্মকর্তা, তিনি একটা অফিসের হিসাব বিভাগে ছিলেন, ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট কিনে সেঞ্চুরি করেছেন। মানে ঢাকা শহরে তাঁর কেনা ফ্ল্যাটের সংখ্যা শতক পেরিয়েছে। তিনি অপরাজিতই থাকতে পারতেন, ব্রায়ান লারার অপরাজিত চার শর মতো, কিন্তু বাদ সাধল দুর্নীতি দমন বিভাগ। ভদ্রলোকের চাকরি চলে গেছে, মামলা-মোকদ্দমা চলছে। তিনি অবশ্যই অফিসে কাজ করতেন। তিনি কী করেছিলেন? শুনতে পেলাম, তিনি একটা ক্লায়েন্টের বিল সরকারি অফিসের কম্পিউটার থেকে গায়েব করে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ সরকারের পাওনা হাজার কোটি টাকা থেকে একটা পার্টিকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বিনিময়ে তিনি শতকোটি টাকা পেয়েছিলেন। সেসব দিয়ে তিনি ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট-বিক্রি-মন্দা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পান রাষ্ট্রপতি। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপরে প্রধানমন্ত্রী, ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অন্যান্য কর্মকর্তার বেতন স্বাভাবিকভাবেই এর নিচে। আর এই বেতন বৃদ্ধি ঘটেছে গত বছর। এর আগে রাষ্ট্রপতির বেতন ছিল ৬১ হাজার ২০০ টাকা। ২৫ বছর চাকরি করে সর্বোচ্চ কত আয় করতে পারেন একজন? ২৫ বছর আগে কর্মকর্তাদের বেতন শুরু হতো মাসে ৪ হাজার টাকা দিয়ে। অর্থাৎ কিনা গড়ে কোনো সরকারি কর্মচারীর সারা জীবনের মোট বেতন ৫০ লাখ টাকার বেশি হয় না। এখন তিনি ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট কিনলেন কোন টাকায়, ছেলেমেয়েকে দেশে বা বিদেশে পড়ালেন কোন টাকায়, শ্যালিকার বিয়েতে সাতটা অনুষ্ঠান করলেন কোন টাকায়? দুই কেজি যদি বিড়ালের ওজন হয়, মাংসের ওজন গেল কই? আর দুই কেজি যদি মাংসের ওজন হয়, বিড়ালের ওজন গেল কই? উফ। আবারও বিড়াল? আবারও কালো বিড়াল। না না, আমি কালো বিড়াল নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। 

আমি আসলে আজকের কলামটা লিখতে চেয়েছিলাম ছুটি নিয়ে, আনন্দ নিয়ে। আমাদের জীবনে অবসর, আনন্দ, বিনোদনের উপকারিতা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাজে কথা প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। কারণ, মানুষ ব্যয় করে বাঁধা নিয়ম অনুসারে, অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে। যেমন বাজে খরচ, তেমনি বাজে কথা। বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়।’ সারাটা বছর তো আমরা কাজই করছি, কিছুটা দিন নাহয় আমরা অবকাশেই কাটালাম।
কাজের কথা তো বহু হয়, এবার নাহয় একটু অকাজের কথা হোক। বাজে কথা হোক।

সরকার আরেকটা ভালো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এ বছর থেকেই বাতিল করেছে। আমাদের বাচ্চাগুলোর জীবনটাকে পরীক্ষা নামের মাড়াইকলের মধ্যে ফেলে আমরা আখের ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছিলাম। এবার বাচ্চারা একটু আনন্দে থাকুক। আনন্দের সঙ্গে শিখুক।

রবীন্দ্রনাথেরই আরেকটা কথা মনে পড়ছে। ‘আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না।’

শুধু কাজ আর কাজ, শুধু লেখা আর পড়া আর পরীক্ষা—এতে খুব কাজও হয় না, লেখাপড়াও হয় না। জাপানের লোকেরা সত্যিকারের কাজপাগল। জাপান সরকার তাই উদ্যোগ নিয়ে, আইন করে জাপানের লোকদের কাজ কম করতে বলছেন। ছুটি নিতে বলছেন। আনন্দ করতে, আলসেমি করতে বলছেন। জাপানের কর্মচারীরা বিনোদন ছুটি নেন না, বিনোদন ছুটি নিলে তাঁদের বিনোদন ভাতা দেওয়া হয়, সেটাও তাঁরা তোলেন না। শেষে আইন করা হয়েছে, বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি নিতেই হবে এবং বিনোদেন ভাতা খরচ করতেই হবে। এটা কেন করছে জাপান সরকার? কারণ, বেশি কাজ করলেই কাজের কাজ হয় না। আনন্দের সঙ্গে কাজ করলেই কাজটা হয় কাজের মতো।

এবার সরকারি ছুটি নয় দিন। এই নয় দিনে মানুষ ঘুমাক, গড়াক, আলসেমি করুক। বই পড়ুক, অপ্রয়োজনীয় বই, অপাঠ্য বই। গান শুনুক, ছবি দেখুক, টেলিভিশনের ঈদের অনুষ্ঠান দেখুক, বাড়িতে যাক, বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হোক, বেড়াতে যাক, দেশে কিংবা দেশের বাইরে। চরৈবেতি থেকে এবার হোক চড়ুইভাতি। নয়টা দিন অফিস বন্ধ থাকবে, নয়টা দিন বন্ধ থাকুক ক্রসফায়ার, নয়টা দিন বন্ধ থাকুক বাঁ হাতের কারবার। নয়টা দিন কষ্ট করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি কপি পেস্ট করতে হবে না যেওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা গুলি করলে পাল্টা গুলি চালাতে হয়, তখন ক্রসফায়ারে পড়ে...

কিন্তু সবার ছুটি হলেও অনেকেরই ছুটি থাকবে না। যেন নাগরিকেরা নিরাপদে থাকতে পারে বা চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে, পুলিশ বাহিনীকে জেগে থাকতেই হবে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-চিকিৎসা বিভাগের কর্মীদের তাই ছুটি নেই। আমরা বলাবলি করি, ছুটির দিনে যেন কেউ অসুস্থ না হয়। কারণ, ডাক্তার সাহেবেরাও মানুষ, তাঁদেরও ছুটি চাই, তাঁদেরও ঈদ করতে বাড়ি যেতে হয়। সেটাও একটু পরিকল্পনা করে করা ভালো, ছুটির দিনেও মানুষ অসুস্থ হবেই, হৃদ্‌রোগ হবে, সড়ক দুর্ঘটনা, আল্লাহ না করুক, হবেই। হাসপাতালে মানুষ যাবেই, তারা যেন চিকিৎসা পায়। সরকারি ডাকের অপেক্ষা আজকাল কেউ করে কি না, জানি না। তবে এই কদিন জমি রেজিস্ট্রি হবে না, মামলা-মোকদ্দমা হবে না, টেন্ডার হবে না, পাসপোর্ট পাওয়া হবে না। আবার সরকারি অফিসে বিদ্যুৎ পুড়বে না, ফ্যান ঘুরবে না। এর ফলে লাভ বেশি হবে, নাকি ক্ষতি, সেটা কিন্তু হিসাবসাপেক্ষ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নয় দিনের ছুটি দিয়েছেন, এর আগে পয়লা বৈশাখে বোনাস দিয়েছেন, দারুণ কাজ করেছেন তিনি। আমরা, যারা সরকারি চাকুরে নই, দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর চোখ সরু করে ঈর্ষা ভরা চোখে তাকাচ্ছি সরকারি চাকুরেদের দিকে। আর কবীর সুমনের মতো ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজছি ছুটি—

আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আমায় চেয়ো না রাধা—আমি নই শ্যাম,

হারিয়েছি বাঁশিখানা, হয়ে গেছি তালকানা—ভুলে গেছি নাম।

তবুও তোমায় বলি, ইঁদুর দৌড়ে গলি চিনে হরদম,

ইন্টারনেটে ঢুকে, খুঁজছি কপাল ঠুকে—ছুটি ডট কম।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক  সাংবাদিক