অক্সিজেন সিলিন্ডার এই মুহূর্তে এ দেশের সবচেয়ে প্রার্থিত ও দুর্লভ জিনিসগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে করোনা রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীকেই শ্বাসকষ্টের জন্য কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে এখন। মুমূর্ষু প্রিয়জনদের বাঁচানোর প্রয়োজনে অনেক মানুষ এখন হন্যে হয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ করছেন। সিলিন্ডার বাসায় বা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন।
যেহেতু অক্সিজেন সিলিন্ডারের এ চাহিদা আর ব্যবহার আরও অনেক দিন আমাদের জীবনের একটা অনিবার্য অংশ হয়ে থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়, তাই অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার, সংরক্ষণ আর পরিবহনের কিছু বিপদ, আর তা এড়াতে কিছু সাবধানতার কথা উল্লেখ করছি।
অক্সিজেন যেমন জীবনদায়ী, তেমনি সেই অক্সিজেনই আবার জীবননাশী হতে পারে। যেকোনো আগুনের প্রধানতম একটি অনুষঙ্গ হলো বাতাসে থাকা অক্সিজেন। যেসব জায়গায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বা অন্য কোনোভাবে অক্সিজেনের সরবরাহ আছে, সেখানে অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। এর কারণ হলো, ‘অক্সিজেনসমৃদ্ধ পরিবেশ’ বা ‘অক্সিজেন-এনরিচড অ্যাটমোসফিয়ার’, অর্থাৎ যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ সাধারণ পরিবেশের থেকে বেশি, সেখানে অগ্নিদুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং দুর্ঘটনা ঘটলে তা অনেক মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যেসব বস্তু সাধারণ পরিবেশে হয়তো দাহ্য নয়, অক্সিজেনসমৃদ্ধ পরিবেশে তা তীব্রভাবে দহনপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। যেসব ঘটনা সাধারণ পরিবেশে অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, অতিরিক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সেই ছোটখাটো ঘটনাগুলো (ছোট কোনো স্ফুলিঙ্গ, ধূমপান, নিভিয়ে ফেলা সিগারেট, ধাতুতে-ধাতুতে ঘর্ষণ, যেকোনো তাপের উপস্থিতি ইত্যাদি) ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার সূচনা করতে পারে। অক্সিজেনসমৃদ্ধ পরিবেশে অগ্নিশিখার তাপমাত্রা বেশি হয়, আগুন থেকে তাপ নির্গমনের হার (হিট রিলিজ রেইট) অধিক হয় এবং আগুন স্বাভাবিকের থেকে বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব কারণে অতিরিক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিপূর্ণ কোনো স্থানে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা নির্বাপণ করা প্রায় দুঃসাধ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটা দুর্ঘটনাটিসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালের আইসিইউ বা অক্সিজেনের সরবরাহ আছে—এমন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার এ রকম অনেক নজির আছে। তাই অক্সিজেন ব্যবহার করা হয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের এ রকম স্থানগুলোয়, যেখানে গুরুতর অসুস্থ রোগীরা থাকে, সেখানে অগ্নিশনাক্তকরণ এবং অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অক্সিজেন সিলিন্ডারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এর ভেতরে খুবই উচ্চ চাপে (আমাদের সাধারণ পরিবেশের বায়ুচাপ থেকে ১০০-১৫০ গুণ বেশি চাপ) অক্সিজেন সংরক্ষিত থাকে। তাই কোনো ধাক্কা, আঘাত বা এ রকম কোনো কারণে সিলিন্ডারের শারীরিক (ফিজিক্যাল) ক্ষতি, সূর্যালোক বা অন্য কোনো তাপের উপস্থিতি, সিলিন্ডারকে নিয়মমাফিক স্থাপিত না করা, সিলিন্ডারের ভাল্ভ খোলা-বন্ধ করার সময়ে সঠিক নিয়ম না মানা, ইত্যাদি কারণে সেটি বিস্ফোরিত হতে পারে, যা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তাই অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার, সংরক্ষণ আর পরিবহনে খুবই সতর্ক থাকা এবং নির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে চলা আবশ্যিক। যেমন:
১. ব্যবহারের সময় সিলিন্ডারটিকে স্ট্যান্ড বা কার্টে শক্তভাবে স্থাপন করা।
২. সিলিন্ডারের কাছাকাছি যেন কোনো ধরনের তাপের উৎস থাকতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
৩. যে স্থানে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে, সেখানে কোনোভাবেই কোনো ধরনের ক্ষুদ্রতম স্ফুলিঙ্গও (ইলেকট্রিক স্পার্ক, সিগারেটের স্ফুলিঙ্গ, ধাতব-ঘর্ষণে তৈরি ফুলকি, কোনো ধরনের ওয়েল্ডিংয়ের কাজ ইত্যাদি) যাতে তৈরি হতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
৪. অক্সিজেন ব্যবহারের সময় অ্যারোসল, পেইন্ট বা এ রকম জিনিস স্প্রে না করা।
৫. বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা আছে—এ রকম স্থানে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা, কারণ সে ক্ষেত্রে বদ্ধ জায়গায় বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে অক্সিজেনসমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
৬. অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবহনের সময় খেয়াল রাখা যাতে কোনোভাবেই আঘাত বা ধাক্কা না পায়, বা গড়িয়ে না যায়, সরাসরি সূর্যালোক যাতে সিলিন্ডারে বেশি সময় না পড়ে, ইত্যাদি।
৭. সর্বোপরি, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়মাবলি আছে (ভাল্ভ খোলা/বন্ধ করা, রেগুলেটর নব নিয়ন্ত্রণ করা, হ্যান্ডেলের পজিশন পরীক্ষা করা, ইত্যাদি), সেগুলো জেনে, প্রশিক্ষিত হয়ে তারপর সিলিন্ডার ব্যবহার করা।
৮. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
করোনা রোগের এই পরিস্থিতিতে মুমূর্ষু প্রিয়জনদের জীবন বাঁচানোর জন্য অক্সিজেনের চাহিদা এ মুহূর্তে দেশে আকাশচুম্বী। জীবনদায়ী সেই অক্সিজেন আমাদের অসতর্কতা আর অজ্ঞানতায় যেন ভয়ংকর দুর্ঘটনা এবং জীবননাশের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সিলিন্ডার সরবরাহকারী, পরিবহনকারী ও ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবহারকারী সবার সর্বোচ্চ সতর্কতা একান্ত কাম্য।
ড. মো. আশিকুর রহমান: ফায়ার ডায়নামিকস গবেষক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিনিরাপত্তা কর্মসূচির সদস্য।