‘সিলেটে আর কুড়িগ্রামে একসঙ্গে বড় বন্যা হয়েছে। রাজীবপুর উপজেলার নদীসহ প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে ডুবে ছিল। সরকার সিলেটের দিকে এত মনোযোগ দিল, কুড়িগ্রামে তো দিল না।’ কথাগুলো মুঠোফোনে বলছিলেন উপজেলাভিত্তিক ২০০ গুণ বৈষম্যের শিকার কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিকুর রহমান। জেলাভিত্তিক প্রায় ২৭ গুণ বৈষম্যের শিকার কুড়িগ্রামে যখনই বন্যা হোক না কেন, সরকারের ত্রাণ তৎপরতা পর্যাপ্ত থাকে না বললেই চলে। যেটুকু থাকে, তা–ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বণ্টন হয় না।
সাম্প্রতিক বন্যায় রংপুর বিভাগ, সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন বন্যা–পরবর্তী সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও আবারও পানি বাড়ছে, আবার বন্যা দেখা যাচ্ছে। রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব এলাকায় একবার বন্যার আঘাত দূর হতে না হতে আরেক বন্যা এসে আঘাত হানে। উপর্যুপরি বন্যার আঘাতে বিপর্যস্ত জনপদের দিকে নজর নেই সরকারের। জনপ্রতিনিধিরা এতটাই গণমানুষবিমুখ যে তাঁদের কথা ভুলেই গেছে অসহায়-দুর্গত মানুষেরা। এ মৌসুমে আরও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কুড়িগ্রামে এ বছর যে বন্যা হয়েছে, অন্যান্য বছর তার চেয়ে অনেক বেশি বন্যা হয়। সেই বন্যার সময়েও সরকারের তৎপরতা থাকে না। রংপুর অঞ্চলের মানুষ এবার তুলনা করার সুযোগ পেয়েছে। রংপুর অঞ্চলের সঙ্গে সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ তো নতুন নয়। যেমন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুরের জন্য বরাদ্দ থাকে নামমাত্র, রংপুরে উন্নয়নের কোনো বড় প্রকল্প নেই, অর্থনৈতিক জোন কেবল ঘোষণাতেই আছে। এমনকি করোনাকালে ত্রাণ বিতরণেও সরকারি বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। অথচ সারা দেশে গড় দারিদ্র্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দারিদ্র্যের হার রংপুর বিভাগে।
সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে ডুবে ছিল এবারের বন্যায়। কুড়িগ্রামে বর্ষা মৌসুম এলেই স্থানবিশেষে প্রস্থে ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার-গঙ্গাধর নদের পানিতে ৪০ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি প্রস্থে পানির প্রবাহ তৈরি হয়। ব্রহ্মপুত্র যে পরিমাণ পানি বহন করে, তা উজান থেকে বাংলাদেশে আসা মোট পানির অর্ধেকের চেয়ে বেশি। কুড়িগ্রামে নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
সিলেটে যত ধনাঢ্য পরিবার থাকুক না কেন, বন্যার মতো দুর্যোগে তাদের পাশে সর্বোচ্চ সহায়তার হাত বাড়ানোই যৌক্তিক। অর্থবিত্ত যতই থাকুক, বন্যাকালের ভয়াবহতায় তা অনেক সময় কোনো কাজে আসে না। তাই সিলেটের বন্যায় সরকারি-বেসরকারি সব রকম সহায়তা প্রয়োজন ছিল, বরং আরও বেশি হলে ভালো হতো। সিলেটে অনেক মানুষ চরম বিপদে পড়েছেন। একটি টেলিভিশেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, সহায়তা পর্যাপ্ত পাওয়া গেছে।
যখন নদীগুলো প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতো, তখন এর কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয়নি। যখন নদীগুলো পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তখন নদীগুলোর বৈজ্ঞানিক পরিচর্যা প্রয়োজন। কম পানিতে এখন বন্যা মূলত ব্যক্তি-রাষ্ট্রের দায়ে। নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা হলে কম পানিতে বন্যা হবে না। বন্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নদীবান্ধব উন্নত প্রযুক্তির আলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদী বাঁচাতে হবে। সরকারকেও বৈষম্যমূলক ভূমিকা থেকে সরে আসতে হবে।
গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হলো সিলেটের বন্যার খবর। ফলাও করার মতো বটে। ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে আমরা এসব খবরই পড়লাম, দেখলাম এবং শুনলাম। কুড়িগ্রামের বন্যার খবরও দেখেছি, শুনেছি এবং পড়েছি। তবে তা সামান্যই। এর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ হতে পারে, গরিব মানুষের প্রতি অবহেলা সহজাত প্রবৃত্তি। বন্যার ছবি এবং ভিডিওগুলোতে দেখলাম সিলেটের বহুতল ভবনের নিচতলা ডুবে যাচ্ছে পানিতে। কুড়িগ্রামের বন্যায় দেখলাম টিনের চাল ডুবে যাচ্ছে বন্যায়। সিলেট–রংপুর বিভাগের বন্যার্তদের জন্য সহায়তা পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল। বন্যা–পরবর্তী স্বল্পমেয়াদি–দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সিলেটের বন্যায় যেভাবে গোটা দেশের মনোযোগ পেল, সেটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে কুড়িগ্রামসহ অন্যান্য বন্যাকবলিত অঞ্চলের বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব না পাওয়াটাও দুঃখজনক।
টিনের ঘরে থাকা দুঃখী মানুষগুলোর জন্য আরও মনোযোগ জরুরি। বড় বড় জনপ্রতিনিধি, বিশেষ করে নির্বাচনে যাঁদের জনসমর্থন প্রয়োজন হয় না, তাঁদের অনেকেই নেই, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও নেই। কেজি কেজি চাল-ডাল ত্রাণ সহায়তায় কুড়িগ্রামের মানুষের পরিত্রাণ হবে না।
রংপুর বিভাগে কেবল কুড়িগ্রামে নয়, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুরেও বন্যা হয়েছে। সিলেটের বন্যা এবং রংপুরের বন্যা প্রায় অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। আসাম ও মেঘালয়ে এ বছর অনেক বৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেই পানি সিলেট দিয়ে প্রবেশ করেছে। আবার পশ্চিমবঙ্গ, সিকিমের পানি তিস্তা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পানিপ্রবাহের পথ ভালো থাকলে এসব পানি দ্রুতই নেমে যেত। যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে পানি নেমে যেতে বিলম্ব হয়েছে, সেসব জলাবদ্ধতার কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর অবৈধ দখল। পানি ধীরে নেমে যাওয়ার কারণ, নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। সিলেটের কুশিয়ারা, সুরমাসহ অন্যান্য নদীর অবস্থা ভালো থাকলে বন্যার ভয়াবহতা এই পর্যায়ে পৌঁছাত না। সিলেটের পানি ধীরে নেমে না যাওয়ার আরেকটি কারণ হাওর দখল এবং অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক প্রকল্প নির্মাণ।
কুড়িগ্রামে অর্ধশতাধিক নদীসহ রংপুর বিভাগের এমন একটি নদীও নেই যে নদীর অবস্থা ভালো। প্রবল স্রোত দেখে মনে হবে নদীগুলোতে প্রচুর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বাস্তবে অনেক নদীতে হাঁটুসমান পানিতে এমন দেখা যাচ্ছে।
দেশে প্রতিবছর কোথাও না কোথাও বন্যা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি জেলায় প্রতিবছর বন্যা হয়। এসবের কোথাও কোথাও ত্রাণ পৌঁছায়, কোথাও পৌঁছায় না। সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মানে নানা অনিয়মের আখড়া। সরকারি যে ত্রাণ দেওয়া হয়, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে দুর্গতদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। বেসরকারিভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হয়, সেগুলোতে কেউ একাধিকবার পায়, দুর্গম এলাকার অনেকেই পায় না।
কদিন আগে সমাজকর্মী সাখাওয়াত স্বপন ফেসবুকে লিখেছেন ‘ত্রাণ নয় পরিত্রাণ চাই।’ সংকটকালে কিছুটা ত্রাণের প্রয়োজন থাকলেও বন্যার দুর্যোগ থেকে স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ জরুরি। বিশ্বব্যাপী নদী ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থাপনার কোনো ছাপ নেই। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে আমাদের নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের ছোট নদীগুলো প্রায় বিলীন। যখন নদীগুলো প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতো, তখন এর কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয়নি। যখন নদীগুলো পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তখন নদীগুলোর বৈজ্ঞানিক পরিচর্যা প্রয়োজন। কম পানিতে এখন বন্যা মূলত ব্যক্তি-রাষ্ট্রের দায়ে। নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা হলে কম পানিতে বন্যা হবে না। বন্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য নদীবান্ধব উন্নত প্রযুক্তির আলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদী বাঁচাতে হবে। সরকারকেও বৈষম্যমূলক ভূমিকা থেকে সরে আসতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
wadudtuhin@gmail.com