মতামত

কেমন হতে পারে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। এটা আশার কথা এবং দীর্ঘদিনের চাওয়াও বটে। কারণ, বিসিএস পরীক্ষায়, বিশেষ করে প্রিলিমিনারিতে যে ধরনের প্রশ্ন থাকে, সেগুলো পারা না পারা মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভর করে। যে যত বেশি তথ্য মুখস্থ করে ধারণ করতে পারে, তার বিসিএস পরীক্ষায় সফলতার সম্ভাবনা তত বেড়ে যায়। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা বিসিএসের গাইড মুখস্থ করা শুরু করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পড়াশোনায়ও শিক্ষার্থীদের ঘাটতি রয়ে যায়।

সর্বশেষ ৩৫তম বিসিএসের প্রশ্নপদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল। তার আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ছিল ১০০ নম্বরের। ৩৫তম বিসিএস থেকে প্রিলিমিনারি ২০০ নম্বরের করা হয়। এর মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ৩৫, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য ৩৫, বাংলাদেশ বিষয়াবলি ৩০, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ২০, ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ১০, সাধারণ বিজ্ঞান ১৫, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি ১৫, গাণিতিক যুক্তি ১৫, মানসিক দক্ষতা ১৫, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন ১০। বিষয়ভিত্তিক নম্বর বণ্টন নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয় চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রাথমিক বাছাই হিসেবে। এ নম্বর পরে যোগ হয় না। এ পরীক্ষায় বাংলা সাহিত্য বা ইংরেজি সাহিত্যের গভীর থেকে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। বর্তমানে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য থেকে প্রিলিমিনারিতে যে ধরনের প্রশ্ন থাকে, তার উত্তর দেওয়া ওই সব বিষয়ে চার বছর অনার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের পক্ষেই কেবল সম্ভব। আবার বিজ্ঞান থেকে এমন সব প্রশ্ন করা হয়, যেগুলোর সমাধান পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞান না থাকলে করা সম্ভব নয়। এমনকি গাণিতিক যুক্তি অংশে উচ্চতর গণিত থেকে প্রশ্ন থাকে।

বর্তমান সিলেবাসকে ঢেলে সাজানোর জন্য ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নের কাঠামো নির্ধারণে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ডেকে পরামর্শ নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নে যথাসম্ভব বিকল্প না রাখাই ভালো হবে। অর্থাৎ যে কয়টি প্রশ্ন থাকবে, সে কয়টির উত্তর সবাইকে দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, তাই কোনো বিষয়ে প্রার্থীর জানা না জানার ব্যাপারটিও যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ।

বিসিএসের প্রিলিমিনারি তো বিশেষ বিষয়ে উচ্চতর যোগ্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষা নয়। বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা যাচাই করার দরকার হয় সেই প্রার্থীদের জন্য, যাঁরা পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডারে আবেদন করেন। আর নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন থেকে তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর প্রশ্ন দিয়ে প্রিলিমিনারিতে আসলে কী যাচাই করা হয়, বোঝা কঠিন। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের প্রশিক্ষণের সময়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন সম্পর্কে ধারণা দিলে সেই জ্ঞান ও উপলব্ধিকে তিনি বরং তাঁর কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন। এর বিপরীতে প্রার্থীর কর্মকৌশল ও বিশ্লেষণক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। এসব বিবেচনায় প্রিলিমিনারি প্রশ্নে বিষয়ভিত্তিক নম্বর বিভাজন হতে পারে এ রকম: বাংলা ৩০, ইংরেজি ৩০, বাংলাদেশ ২০, আন্তর্জাতিক ২০, সাধারণ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি ৩০, সাধারণ গণিত ২০, মানসিক দক্ষতা ৩০, কর্মকৌশল ও বিশ্লেষণক্ষমতা ২০।

এখন আসা যাক প্রশ্নের ধরনে। তথ্যনির্ভর প্রশ্নের বদলে এমন প্রশ্ন করতে হবে, যা থেকে প্রার্থীর বিশ্লেষণ, চিন্তন ও সৃজনক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে, যা থেকে প্রার্থীর দূরদর্শিতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মিলবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নের অনেক রকম কাঠামো আছে। একই প্রশ্ন সেটে কয়েক রকম কাঠামো অনুসরণ করা যায়। বর্তমানে ২০০টি প্রশ্নই এক রকম কাঠামোয় হয়। নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নগুলোকে বিভিন্ন গুচ্ছে সাজিয়ে সে অনুযায়ী প্রশ্ন রাখা যায়। যেমন বাংলা বিষয়ের জন্য তিনটি গুচ্ছ থাকতে পারে: প্রথম গুচ্ছে একটি অনুচ্ছেদ দিয়ে সেখান থেকে উপলব্ধি ও ভাষাজ্ঞান যাচাইয়ের জন্য ১০টি প্রশ্ন, দ্বিতীয় গুচ্ছে বিভিন্ন সময়ের বাংলা সাহিত্যের সাধারণ ধারণা পরীক্ষা করার জন্য ১০টি প্রশ্ন এবং তৃতীয় গুচ্ছে সরাসরি ভাষাজ্ঞান যাচাইয়ের জন্য ১০টি প্রশ্ন রাখা যায়। বিজ্ঞান ও গণিতের প্রশ্নগুলো এমন হবে, যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে কিংবা প্রতিদিন যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়।

পুরোনো প্রশ্নগুলোর সমন্বয়ে একটি ডিজিটালাইজড প্রশ্নভান্ডার তৈরি করা যায়। চূড়ান্ত প্রশ্ন সেট তৈরি করার সময়ে যাঁরা মডারেশন করবেন, তাঁরা এখান থেকে যাচাই করে নিতে পারবেন, কোনো প্রশ্ন আগে এসেছিল কি না। বিসিএস পরীক্ষার আদৌ কোনো সিলেবাস থাকার প্রয়োজন হয় না। তবে সিলেবাস দিয়ে দিলে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সিলেবাসকে অনুসরণ করতে হবে। আবার সিলেবাসের একই জায়গা থেকে অনেক প্রশ্ন না করে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্ন নেওয়া ভালো। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন সমন্বয়কারীদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় একটি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর দেওয়া হয়, আর একটি ভুল উত্তরের জন্য শূন্য দশমিক ৫ নম্বর কাটা হয়। প্রতিটি প্রশ্নে যেহেতু চারটি অপশন থাকে, সেহেতু ভুল উত্তরের জন্য শূন্য দশমিক ২৫ কাটা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।

বর্তমান সিলেবাসকে ঢেলে সাজানোর জন্য ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নের কাঠামো নির্ধারণে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ডেকে পরামর্শ নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নে যথাসম্ভব বিকল্প না রাখাই ভালো হবে। অর্থাৎ যে কয়টি প্রশ্ন থাকবে, সে কয়টির উত্তর সবাইকে দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, তাই কোনো বিষয়ে প্রার্থীর জানা না জানার ব্যাপারটিও যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া একই রকম প্রশ্ন লিখিত পরীক্ষার আবশ্যিক অন্য বিষয়ে রাখা ঠিক নয়। যেমন বাংলা ও ইংরেজি দুটি বিষয়ের লিখিত পরীক্ষাতেই ইংরেজি অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদ করতে দেওয়া হয়। আবার যে ধরনের রচনা বাংলা বিষয়ে থাকে, একই ধরনের রচনা বাংলাদেশ বিষয়ে থাকে। লিখিত পরীক্ষায় রচনা লেখার জন্য ৪০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় বিভিন্ন পরীক্ষক বিভিন্নভাবে নম্বর প্রদান করেন। এতে দুই পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের ব্যবধান বেড়ে যায়। তাই লিখিত পরীক্ষার কোনো প্রশ্নে ২০-এর বেশি নম্বর রাখার দরকার নেই। এমনকি যেকোনো বড় ও দীর্ঘ প্রশ্নের জন্য কোন কোন পয়েন্টে লিখতে হবে এবং সেসব অংশের জন্য কত কত নম্বর বরাদ্দ থাকবে, তা প্রশ্নে স্পষ্ট উল্লেখ করতে হবে।

বর্তমান পদ্ধতিতে দুজন করে পরীক্ষক লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখেন। এটি ভালো উদ্যোগ। ভাইভার মাধ্যমে কোনো প্রার্থীকে যাতে বঞ্চিত করা না হয়, সে জন্য মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০০-এর বদলে ১০০ করা উচিত। অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা, মডারেশন করা ও খাতা মূল্যায়নের সুযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে, যাতে মুখস্থনির্ভরতা বন্ধ হয়, যাতে পরীক্ষার হলেই প্রশ্নের অনুচ্ছেদ, আলোচনা ও সমস্যা নিয়ে পরীক্ষার্থী কিছু সময়ের জন্য ভাবতে বাধ্য হন এবং এরপর উত্তর লিখতে বা উত্তর দাগাতে শুরু করেন।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক