Thank you for trying Sticky AMP!!

খালেদার অপরাধ কি 'নৈতিক স্খলন'?

খালেদা জিয়ার অপরাধ ‘নৈতিক স্খলন’ কি না, এই প্রশ্ন এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এর ওপর তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া নির্ভর করেছে। এবং সে কারণে আইনের চোখে নৈতিকতা কী, তা জানতে হবে। আমরা দেখলাম, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ কী তা নির্ধারণে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যেসব ভারতীয় উদাহরণের ওপর এ পর্যন্ত দাঁড়ানো, তাতে এটা স্পষ্ট যে প্রতিটি ঘটনা তার নিজস্ব গুণাগুণ দিয়ে যাচাইযোগ্য। প্রশ্ন উঠবে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করা নৈতিক স্খলন কি না।

১৯৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে একটি রায় দিয়েছিলেন। সাতক্ষীরার একজন ইউপি চেয়ারম্যান মনোরঞ্জন মুখার্জি অবৈধভাবে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭০৯ একর জমি দখলে রাখার দায়ে সামরিক আদালতে সাত বছর দণ্ডিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তার বৈধতা রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। আইনজীবী সুধাংশু শেখর হালদারের (আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা) যুক্তি আদালত মেনেছিলেন, তিনি অপরাধী, আইন ভেঙেছেন, কিন্তু নৈতিক স্খলন হিসেবে তিনি অযোগ্য হবেন না। ‘ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছিল কি না মনে পড়ে না, আমি চেয়ারম্যান পদে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছিলাম, ’ মি. মুখার্জি শনিবার আমাদের টেলিফোনে নিশ্চিত করেন।

আবার এরশাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। এরশাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়া নৈতিক স্খলন নয়-ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের এই নিবেদন আপিল বিভাগ নাকচ করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি সরাসরি অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন। এবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় এসেছে যে তিনি প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার কুয়েতি অনুদান প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে দুটি বেসরকারি ট্রাস্টকে দিয়েছেন। ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে খালেদা-তারেকসহ ছয়জনকে দণ্ডিত এবং সমরূপ অর্থ সমহারে প্রত্যেককে জরিমানা করা হয়েছে। রায়ে লেখা দেখি, মার্কিন প্রবাসী শরফুদ্দীন আহমেদই প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী কামালের সহায়তায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাই আদালতের পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়াকে এরশাদের মতো সরাসরি অর্থ আত্মসাৎকারী নয়, বরং যোগসাজশকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠবে, এরশাদের অপরাধ নৈতিক স্খলন হলে খালেদা জিয়ার ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ বা ‘যোগসাজশ’ নৈতিক স্খলন হিসেবে বিবেচিত হবে কি না।

অপরাধের দায়ে কেউ দণ্ডিত হলেই এবং সেই রায়ের কার্যকারিতা আপিলে স্থগিত হোক বা না হোক, তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন না। প্রমাণ করতে হবে যে অপরাধ সংঘটনে ব্যক্তির নৈতিক স্খলন ঘটেছে। এটা তাই খতিয়ে দেখা দরকার যে আমাদের নির্বাচন কমিশন, সুপ্রিম কোর্ট ও সংসদ ‘নৈতিক স্খলন’ বিষয়ে এ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং তার ভিত্তি কী।

সংবিধানের ৬৬ (২ ঘ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কেউ নির্বাচনের অযোগ্য হবেন, যদি ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে’। নৈতিক স্খলন কী, তা বুঝতে ১৯৮৯ সালের হাইকোর্টের ওই রায় ছাড়াও ২০০১ সালে এরশাদের মামলায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের দুটি রায় এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের বইয়ে বর্ণিত তাঁর আইনি মতামত, যা এরশাদের মামলাতেই আপিল বিভাগে সমর্থিত হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যার অপর্যাপ্ততার ঘাটতি পূরণ করে না।

মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ব্যাপক অর্থে সব ধরনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সঙ্গেই নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ জড়িত। কিন্তু এখানে নৈতিক স্খলন সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, অন্যথায় এর ব্যবহার অর্থহীন হয়ে পড়বে। নৈতিক স্খলন নিশ্চিত করতে হলে দুরাচারত্ব বা ডিপ্রাবেটির উপাদান দেখাতে হবে।’ নৈতিক স্খলন কী বুঝতে মাহমুদুল ভারতের পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টের ১৯৬৬ সালের রিসাল সিং বনাম চাংদি রাম মামলার বরাতে তিনটি মাপকাঠির উল্লেখ করেছিলেন। আমরা দেখি, ওই তিনটি মাপকাঠি ১৯৬২ সালে মাঙ্গালি বনাম চাক্কি লাল মামলায় প্রথম স্থির করেছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এ পি শ্রীবাস্তব। ২০০১ সালের ২২ আগস্ট এরশাদের মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে তা সমর্থিত হয়েছিল।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এ শ্রীবাস্তব গ্রন্থিত এই তিনটি মাপকাঠিও অত্যন্ত ব্যাপক বললে ভুল হবে না। ১৯৬২ সালে জনৈক চাক্কি লাল
এক তোলা ভাং নিজের জেলায় বৈধভাবে কিনে পাশের জেলায় গিয়েছিলেন। সেই জেলায় অবশ্য তা বহন করা অবৈধ এবং সেখানে ধরা পড়ার পর তিনি ১০ রুপি জরিমানাসহ দণ্ডিত হন। আর ১৯৬৬ সালে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে চাংদি রামও দণ্ডিত হন। উভয়ে পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচিত
হলে নৈতিক স্খলনের প্রশ্ন ওঠে, হাইকোর্ট তাঁদের পক্ষে রায় দেন।

নৈতিক স্খলনের উল্লিখিত তিনটি মাপকাঠি:
সাধারণভাবে তা বিবেক বা সমাজকে আঘাত দিয়েছে কি না? অপরাধ করার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল কি না? অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি সমাজের চোখে নীতিবিবর্জিত (ম্যান অব ডিপ্রেব ক্যারেক্টার) কিংবা সমাজ তাঁকে খাটো করে দেখে (লুকড ডাউন) কি না। মাহমুদুল ইসলামের মতে, এসবের উত্তর ইতিবাচক হলে কোনো ব্যক্তির নৈতিক স্খলন ঘটেছে।

১৯৯০ সালে পতনের পরে এবং কারাদণ্ডের পরও এরশাদ যে সমাজে পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেখানকার মানুষ তাঁকে ‘লুকড ডাউন’ করেছিল? তাঁর দ্বারা অর্থ আত্মসাতের খবরে বিশেষ করে রংপুরের সমাজের বিবেকে কি আঘাত লেগেছিল? এবং তা দাবি করার আইনি মাপকাঠি কি অভ্রান্ত? বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে?

হাইকোর্টে এরশাদের মামলায় সংসদ নিয়োজিত আইনজীবী রোকন উদ্দীন মাহমুদের বরাতে (মূলত এর উৎস ভেঙ্কাতারামাইয়ার ল লেক্সিকন) লেখা হয়েছে, ‘নৈতিক স্খলন কোথাও সংজ্ঞায়িত নেই। কিন্তু এর অর্থ হচ্ছে ন্যায়বিচার, সততা, বিনয় বা নৈতিক সদ্গুণের যা বিপরীত, তা-ই নৈতিক স্খলন।’ আপিল বিভাগ এই সংজ্ঞা সমর্থন করে বলেছেন, দেশের প্রেসিডেন্ট যদি অর্থ আত্মসাৎ করেন এবং যদি তা তাঁর ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ব্যবহার করেন কিংবা যদি তাঁর জ্ঞাত আয়ের সূত্রের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ জীবনযাপন কিংবা সম্পদ ধারণ করেন, তাহলে তা নিশ্চিতভাবে নৈতিক স্খলন বলে গণ্য হবে। আপিল বিভাগের চোখে এরশাদ যখন অর্থ আত্মসাৎকারী হিসেবে নৈতিক স্খলনকারী, তখন এই সমাজেরই একটি অংশের চোখে তিনি ছিলেন উন্নয়নের কান্ডারি।

সমাজ, সময় ও সংস্কৃতি বদলায়, নৈতিকতা কী, সেটাও একই সঙ্গে বদলায়। ১৯৪৭ সালের পাসপোর্টে মেয়েদের ছবি থাকত না, তখন আমাদের সমাজে তারও একটা নৈতিক ভিত্তি ছিল, কিন্তু সেই নৈতিকতা বদলে গেছে। শেষ করব প্রবীণ আইনজীবী এম আই ফারুকীর মন্তব্য দিয়ে: ‘একটি সমাজের নৈতিকতা কী, তা নির্ধারণ করা সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়, এ কাজ সংসদের। সুতরাং সংসদ তা না করা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের উচিত নয় নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের প্রশ্ন তুলে কারও মনোনয়নপত্র বাতিল করা।’ কিন্তু এতকাল আইন ছাড়াই তো চলে এসেছে, তাতে প্রতিটি সরকারের সায় ছিল। রায়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অপরাধও কিন্তু দুই রকম। তারেককে যেভাবে টাকা আত্মসাতের দায়ে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেভাবে খালেদাকে করা হয়নি। সুতরাং, ক্ষমতার অপব্যবহার নৈতিক স্খলন কি না, সেটা জানতে অনেকেরই আগ্রহ থাকবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর উপসম্পাদক
mrkhanbd@gmail. com