Thank you for trying Sticky AMP!!

গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা কেন, কোন যুক্তিতে

মাংস উৎপাদনে যে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেই দেশে গরুর মাংসের দাম এত লাগামছাড়া কেন

মাংসের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সব সময়েই প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর কমবেশি নির্ভরশীল ছিল। ভারত থেকে গরু আসত সারা বছরই। তবে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে আসত কোরবানি ঈদের আগে। এ দেশের হাটগুলো ভরে উঠত ভারতীয় গরুতে। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু পাঠানোর ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে। ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর সে দেশ থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আসা একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত থেকে গরু আসত অনানুষ্ঠানিক উপায়ে, বহু প্রাণের বিনিময়ে।

২০১৬ সালে দেশের বেসরকারি থিঙ্কট্যাংক সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভারতীয় গরু আসা বন্ধের পরের পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক গরু বাণিজ্যের অর্থনীতি: পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের চিত্র’। ওই গবেষণায় বলা হয়, ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে যত গরু আমদানি হতো, বাজারে বছরে এর আর্থিক মূল্য ছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ওই গবেষণায় একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে। তা হলো, ভারত থেকে আসা গরু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হয় ৭৭ শতাংশ বেশি দামে।

যা–ই হোক, ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেবার (২০১৫) অনেকে ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষের কোরবানি করা হবে না। কারণ, গরুর দাম অনেক বেড়ে যাবে। মাংসের কেজি হবে হাজার টাকা। কিন্তু এ দেশের মানুষের সামর্থ্য যতই সীমিত হোক, কখনো কখনো তারা বুদ্ধিমত্তা ও উদ্ভাবন দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। এ ক্ষেত্রেও ছিল তেমনই। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের খামারিদের জন্য আশীর্বাদ। সারা বাংলাদেশে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত, কী সমতলে, কী পাহাড়ে দেশি, বিদেশি, সংকর—সব জাতের গরুর খামার গড়ে উঠতে থাকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ শুরু করেন। অনেক তরুণ যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া শেষ করে সেখানে চাকরি না করে দেশে ফিরে গরুর খামার দেন। সমাজে উদাহরণ তৈরি হয়। সংবাদপত্রের পাতায়, টিভি রিপোর্টে, ইউটিউবারদের প্রতিবেদনে উঠে আসে সাফল্যের কাহিনি।

তবে ভারত গরু পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার পর আমাদের টনক নড়া যৌক্তিক হয়নি। প্রয়োজন ছিল আগেই এ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। কেবল সংকটে পড়লেই আমরা সমাধানে মনোযোগী হব, এটা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই আমরা স্বাবলম্বী হব, এর আগে হব না?

Also Read: কতটা পথ ছুটলে তবে এতটুকু অন্ন পাওয়া যায়

২০ জানুয়ারি ২০১৯ সালে প্রথম আলোয় ইফতেখার মাহমুদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারত থেকে গবাদিপশু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশে প্রতিবছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। ৩ বছরে (২০১৮-২০) দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশুর উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ লাখ ৯৯ হাজার বেড়ে হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ গরু, ৪৫ শতাংশ ছাগল। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া। দেশে জনপ্রতি মাংসের চাহিদা দৈনিক ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া—সব মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম।

গরু লালন–পালন আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। একসময় এ দেশের গৃহস্থের ঘরে ঘরে গরু ছিল। ঘরের ছেলেমেয়েদের দুধের চাহিদা মেটাতে ও হালচাষের প্রয়োজনে তাঁরা গরু পুষতেন। ধীরে ধীরে যন্ত্রনির্ভর চাষ জনপ্রিয় হওয়ায় গৃহস্থের গোয়াল থেকে গরু কমতে থাকে। আমাদের দেশি গরুগুলো আকারে ছোট হওয়ায় মাংস ও দুধ কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি বড় গরু লালন–পালন জনপ্রিয় হতে থাকে।

২.

যে দেশে খামার নিয়ে এত ভালো ভালো খবর, মাংস উৎপাদনে যে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে দেশের রাজধানীতে গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ঢাকার বাইরে জেলা শহরে প্রায় একই দাম। বুধবার উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহরে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা কেজি, আর দক্ষিণের শহর টেকনাফে বিক্রি হয়েছে ৭৫০ টাকা। গত কোরবানির পর মিয়ানমার থেকে ট্রলারে করে টেকনাফে গরু আসা বন্ধ থাকায় সেখানে অতিমূল্যের একটা কারণ হতে পারে।

কীভাবে, কোন যুক্তিতে গরুর মাংসের দাম এত বেশি হতে পারে, সে প্রশ্ন তুলতে চাই।
যখন সীমান্ত পার হয়ে ভারত থেকে গরু আসত, তখন তো এত দাম ছিল না। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের হিসাবে, ঢাকায় ২০১৪ সালে ১ কেজি গরুর মাংসের গড় দাম ছিল ৩০০ টাকা। মাত্র ৫ মাস আগে গত অক্টোবরে গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কেজিতে বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। শবে বরাতের দিন একলাফে কেজিতে ৫০ টাকা বাড়ানো হয়। আর সংযমের মাস রমজান সামনে রেখে বাড়ানো হয় আরও ৩০ থেকে ৫০ টাকা।

গত কয়েক বছরে গরু পালন আর প্রান্তিক খামারিদের হাতে নেই। রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংসদসহ বড় বড় ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। তাঁরাই এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এখন নিজেরা উৎপাদন করে দাম যখন সীমার মধ্যে থাকার কথা, তখন উল্টো অসীমে পৌঁছে গেল! এর আগে সিটি করপোরেশন একাধিকবার গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি তদারকির অভাবে। ব্যবসায়ীরা পাত্তা দেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাংসের দাম কেন নির্ধারণ করে দেওয়া লাগবে?

১ কেজি মোটা চালের দাম ৪৬ টাকা। একজন দরিদ্র মানুষকে ১ কেজি গরুর মাংস কিনতে হলে ১৫ কেজি চালের সমান টাকা পরিশোধ করতে হবে। এক কেজি মাংসে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের বড়জোর দুই বেলা চলে। এর জন্য ৭০০টি টাকা ব্যয় করা কয়জনের পক্ষে সম্ভব। ধরা যাক, একজন চাকরিজীবী ৫০ হাজার টাকা বেতন পান। তাঁর পক্ষেও অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে ১ হাজার ৪০০ টাকায় ২ কেজি গরুর মাংস কেনা কঠিন। মাংস ব্যবসায়ীরাই বলছেন, দাম বেশি বলে বিক্রিও কমে গেছে। লোকে এখন গরুর মাংস না কিনে সোনালি মুরগি কিনছে।

Also Read: মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের হয়ে পাশে দাঁড়াও

আজ থেকে ৩ দশক আগে গরুর মাংসের কেজি ছিল ৪০ টাকা। মনে আছে, যখন স্কুলে পড়তাম, আমার জন্মস্থান বাগেরহাটের ফকিরহাট বাজারে একটিমাত্র গরু জবাই হতো। তখন চালের কেজি ছিল ৭ থেকে ৮ টাকা। তখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কম ছিল। এখন ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫১১ ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রয়ক্ষমতা সামান্য বাড়লেই সবকিছু আগুন দামে কিনতে হবে কেন?

কেন গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা কেজি? মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, হাট কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ইজারা আদায় করছেন। যেমন গাবতলী গরুর হাট ইজারা নেওয়ার শর্ত হলো, প্রতিটি গরুর সরকার নির্ধারিত খাজনা হবে ১০০ টাকা। কিন্তু এ শর্ত না মেনে ইজারাদারেরা অবৈধভাবে গরুপ্রতি চার বা পাঁচ হাজার টাকাও আদায় করছেন। এভাবে একটি গরু শহরের ভেতরে তিনটি হাটে স্থানান্তরিত হলেই গরুর দাম বেড়ে যায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এর প্রভাব সরাসরি এসে পড়ে মাংসের দামের ওপর। তাদের কথা, এ চাঁদা কমানো গেলে মাংসের দামও কেজিতে ১০০–১৫০ টাকা কমানো যাবে। প্রভাবশালীদের ভ্রাতা কিংবা শ্যালক—এই ইজারাদারদের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

অপর দিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বাজারে গোখাদ্যের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে বেড়ে গেছে গরুর উৎপাদন খরচ। সরকার গোখাদ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নিলে বাজারে মাংসের দাম কমে আসবে। এর বাইরে রয়েছে পশুর ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, চামড়ার দাম কমে যাওয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে খামারির কাছ থেকে কসাই পর্যন্ত একটি গরু পৌঁছাতে তিন-চার হাত বদল হয়। প্রতি হাত বদলে বাড়ে গরুর দাম। আর কত চিৎকার করলে উন্নত হবে বাজার ব্যবস্থাপনা?

আরেকটি তথ্য হচ্ছে, গত কয়েক বছরে গরু পালন আর প্রান্তিক খামারিদের হাতে নেই। রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংসদসহ বড় বড় ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। তাঁরাই এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

৩.

বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ দুলাল টেলিফোনে জানালেন, সেখানে গরুর মাংসের কেজি বাংলাদেশি টাকায় ৫৫০ টাকা। প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি তবারুকুল ইসলামের তথ্যমতে, ওই শহরে প্রতি কেজি মাংস ৪ দশমিক ৯৯ পাউন্ডে বিক্রি হচ্ছে, বাংলাদেশি টাকায় যা ৫৬০ টাকা। নিউইয়র্কের বাসিন্দা কুলসুম আক্তার জানালেন, সেখানে মাংস, দুধ, ডিমের দাম সব সময় কম থাকে। কারণ, সরকার এসব খাতে প্রচুর ভর্তুকি দেয়। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ৫২০ টাকার মতো। কানাডা থেকে লেখক, গবেষক মোস্তফা চৌধুরী জানান, সেখানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ১৩ কানাডীয় ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ৮৮০ টাকার মতো।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ওমান, কানাডার মানুষের মাথাপিছু আয় কত? আর আমাদের মাথাপিছু আয় কত?

৪.

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে জাতীয় সংসদে কেবল বিরোধী দলের সদস্যরাই কিছু কথা বলেন। সরকারি দলের সাংসদদের কোনো কথা শোনা যায় না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ হয়তো এর কারণ। কিন্তু সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে কিছু বলতে মানা আছে কি?

এখনই উদ্যোগ না নিলে গরুর মাংসের কেজি আর ৭০০ টাকা থেকে নামবে বলে মনে হয় না। এ দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে সাধারণত আর কমে না। এ অবস্থায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় শিগগিরই সব পক্ষকে ডেকে, ক্যাবকে রেখে একটা সত্যিকারের গণশুনানির আয়োজন করতে পারে। সেখানে সবার কথা শুনে গরু–মহিষসহ সব মাংসের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: alim.zaman@prothomalo.com