
ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে দেখেছি, একটাই সাল ছিল, অব্দ ছিল, পঞ্জিকা ছিল। আর তা হলো বাংলা পঞ্জিকা। জেঠাইমা জিজ্ঞেস করতেন, আজ কত তারিখ, এর উত্তর ছিল আজ আশ্বিনের কুড়ি কিংবা মাঘের ১২; গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের হিসাব ওই গ্রামে দরকার পড়ত না, প্রচলিতও ছিল না। এর কারণ, আমাদের পরিবার, আমাদের গ্রাম, জীবনযাপন ছিল কৃষিভিত্তিক। বীজ বপন, চারা রোপণ, কাটামারি—সবই হতো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়ের হিসাব অনুসারে। গ্রামবাসীর কেউই প্রায় চাকরি-বাকরি করতেন না; কাজেই জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির হিসাবটা তাঁদের দরকার পড়ত না। আমরা জ্যৈষ্ঠ মাসে অবশ্যই একবার রংপুর শহর থেকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাতানাবালুয়া গ্রামে যেতাম। কারণ, তখন স্কুলে দেওয়া হতো আম-কাঁঠালের ছুটি। আমাদের গ্রামে সারি সারি আমগাছ ছিল, কাঁঠালগাছ ছিল; আমরা গরুর গাড়ি করে বস্তা ভরে বাড়িতে আম আনতাম; আর একটা ডালায় ভরা আম একা নিয়ে উঠানে খেতে বসতাম। জামের দাগে সবার জামাকাপড় রঞ্জিত হতো, সেই দাগ আর উঠতে চাইত না। আমের আঁটির ভেঁপু বানানো ছিল আমাদের সবার সাধারণ স্বাভাবিক কাজ।
শুধু যে কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল বলে বাংলা মাসের দিনক্ষণ সবার মুখস্থ থাকত বা বাড়িতে একটা পকেট পঞ্জিকা অপরিহার্য ছিল তা নয়; ব্যবসায়ী বা কামার-কুমারদের জীবন-জীবিকাও চলত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ধরেই। আমাদের গ্রাম থেকে মাইল কুড়ি দূরে বারুণীর মেলা বসত বছরে একবার। আমরা বলতাম বার্ণির মেলা। সেখানেও আমরা যেতাম গরুর গাড়ি করে। সেই গরুর গাড়িতে আমাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে দাদা-চাচারা যেতেন বেচতে। রসুন আর তরমুজ ছিল আমাদের ফসল। সেই মেলাটার কাছাকাছি হতেই দেখা যেত পথে পিলপিল করে চলেছে মানুষ। তাদের কাঁধে বাঁক, তাতে নানা দ্রব্য। কারওবা মাথায় নানা জিনিস। নানা ধরনের রঙিন খেলনা, বাঁশি, টেপাপুতুল, সোলার তৈরি রঙিন ঘর সাজানোর উপকরণ, বাঁশের জিনিস—কুলা ডালা চালনি, কুমারের তৈরি মাটির জিনিস, খেলনা, টমটমগাড়ি— সবকিছুতেই রং, রঙেরই মেলা যেন। নাগরদোলা ক্যাঁ কোঁ শব্দ করে উঠছে, ছেলে-বুড়োর দল নাগরদোলা নামার সময় ভয়ে চিৎকার করে উঠছে। আমরা অবশ্য নাগরদোলাকে বলতাম চরকি। আর কাগজের যে ফুলটা ঘুরত বাতাসে, সেটাকে বলতাম ঘূর্ণি। ঘুড়িও পাওয়া যেত; চৈত্রের বাতাসে ঘুড়ি ওড়াইনি, এমন চৈত্র আমাদের ছোটবেলায় কখনো আসেনি। পাওয়া যেত লাটিম। খই-মুড়ি-বাতাসা, মুরলি, কান-মুচড়ি, জিলাপি, নানা ধরনের মিষ্টি তো মেলাতে পাওয়া যেতই। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে, এখন যেখানে বাস টার্মিনাল হয়েছে, সেখানটায় বসত চড়কের মেলা। তার প্রধান আকর্ষণ আমাদের কাছে ছিল ঘুড়ি। ঘুড়ির উৎসব বসত, কাটাকাটিরই উৎসব। কিন্তু চড়কপূজায় যে পিঠে আঁকশি বেঁধে মানুষকে ঘোরানো হয়, ওটা আমাদের এলাকায় কখনো দেখিনি।
আমাদের গ্রামখানি ছিল শাহ আবদুল করিমের গানের মতো:
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।
ওই গানে একটা জায়গায় আছে: দিন ছিল সরল, ছিল ধর্মবল। ওই হিন্দু মুসলমান কামার-কুমার-চাষি, সবাই সরল সোজাভাবে ধর্মকর্ম করতেন; বয়স্ক চাষিরা মেলায় বা হাটে যাচ্ছেন, মাথায় টুপি থাকত; যাচ্ছেন কিন্তু বারুণীর কিংবা চড়কের মেলায়; পাট কিংবা গুড় বিক্রি করতে; আসার সময় দা-কুড়াল, হাঁড়িকুড়ি, মিঠাইমণ্ডা কিংবা ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে ফিরবেন। সারল্য ছিল, মেলামেশা ছিল; ভেদাভেদের চিন্তা মাথায় আসত না।
গত শুক্রবার ৮ এপ্রিল ২০২২ লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ শুধু বাঙালির নয়।’ বলতে চেয়েছিলাম, বাঙালি ছাড়া আর যেসব নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের মানুষ আছেন, জনজাতি আছে, বিহারি, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ওঁরাও—সবারই দেশ বাংলাদেশ। তেমনি বাংলাদেশ কেবল মুসলমানের নয়—হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কিংবা এর বাইরে যে ধর্মাবলম্বী, মতাবলম্বী আছেন, বাংলাদেশ তাঁদেরও দেশ।
উৎসব মানে কিন্তু মিলন। উৎসব মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করে। পয়লা বৈশাখ এই কাজটা করে সুন্দরভাবে, সর্বজনীনভাবে। খুব সুন্দর ছবি দেখলাম পত্রিকায়, ভিডিও দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈসাবি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু উৎসব হচ্ছে রাঙামাটিতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে। আমাদের বঙ্গাব্দ সমন্বয়ের একটা সচল উদাহরণ। মোগল আমলে কৃষিপঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে এই পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়। মাসের নামগুলো শকাব্দ থেকে নেওয়া। সাল শব্দটা ফারসি। সন শব্দটা আরবি। সাল গণনার সঙ্গে হিজরির মিল আছে। মানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ—সবারই ঐতিহ্য মিশে আছে বঙ্গাব্দের সঙ্গে। বাঙালির সঙ্গে মিলে গেছে নৃতাত্ত্বিক জনজাতির উৎসব। আবার শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রাচ্যের দেশগুলোয় একই সঙ্গে উদ্যাপিত হচ্ছে নিজস্ব নববর্ষ। থাইল্যান্ডে নববর্ষ বা সংক্রানের ছুটি ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল। বালিতে নববর্ষ ১৫ এপ্রিল।
ষড়্ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বর্ষাকালে যখন আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে, এটা যে বর্ষাকাল, তা কাউকে ক্যালেন্ডার দেখে বুঝতে হয় না। তালপাকা গরম পড়লে বুঝি এসে গেছে ভাদ্র মাস। কাশবনে বাতাসের ঢেউ, বুঝি এসে গেছে শরৎকাল। আকাশ লাল করে শিমুল ফোটে, কোকিল গায়, এ যে বসন্ত। যখন বাঘ-তাড়ানো শীতে কাঁপতে থাকি, জানি এ মাঘ মাস। আর যখন ব্যবসায়ীরা হালখাতার নেমন্তন্ন করতেন, তখন জানি এসে গেছে পয়লা বৈশাখ। এখনো আমাদের বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশক লেখক বা বাইন্ডারদের পাওনা টাকার হিসাব দেন বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, পয়লা বৈশাখে হিসাব কষতে বসেন গত বছরে কী পাওনা হলো, দেনাই-বা কী আছে। প্রথম আলো তার বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার দেয় বাংলা বছরের হিসাবে। সোনার দোকানগুলোয় বা পুরান ঢাকায় বা সারা দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হালখাতার উৎসব হচ্ছে।
কাজেই বাংলা বর্ষপঞ্জি আমাদের জীবনযাপনেরই অংশ। পাকিস্তান আমলে শাসকেরা বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু করলে গ্রামসমাজের পয়লা বৈশাখ উঠে আসে নগর ঢাকায়; ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন এখন পরিণত হয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক এক প্রধান ঐতিহ্য ও উৎসবে। ইউনেসকোর স্বীকৃতি মিলেছে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার। ওটা কিন্তু ১৯৮৯ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমাদের চোখের সামনে শুরু হতে দেখেছি।
আজকের যা প্রচলন, আগামীকাল তা-ই ঐতিহ্য। সংস্কৃতি বদলায়, ঐতিহ্যও বদলায়।
এবারের পয়লা বৈশাখের দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এক. দুই বছর পর করোনার ভয়হীন পরিবেশে এবার পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করা হচ্ছে। দুই. কিছুদিন পরই আসছে ঈদ। এখন চলছে পবিত্র রোজার মাস।
মেলা মানে যেমন মিলন, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা, উৎসবও তা-ই। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ। শিকড়ের সঙ্গে মানুষের যোগ। ঈদে যেমন মানুষ তার গ্রামের বাড়িতে ছোটে, দাদা-দাদি-বাবা-মা-ভাইবোন পুরোনো সহপাঠীর সঙ্গে একত্র হতে চায়, পয়লা বৈশাখেও আমরা আমাদের শিকড়েরই অনুসন্ধান করি। কলকাতার চেয়ে ঢাকার পয়লা বৈশাখ অনেক বেশি আড়ম্বরপূর্ণ। ঢাকায় নববর্ষে লাখো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। পোশাকশিল্পের মেয়েরাও লাল-সাদা শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজে হাঁটতে থাকেন রাস্তায়। প্রায় সবখানেই ছোটখাটো পসরা সাজিয়ে চুড়ি-ফিতা বিক্রি হয়। রেশমি চুড়ির নিক্বণ ওঠে সর্বত্র। কলকাতার রাস্তায় এই জনস্রোতটা দেখিনি। এর কারণ, বাংলাদেশ পয়লা বৈশাখকে অর্জন করে নিয়েছে ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে রক্ত দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে।
করোনাকালে আমরা অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি। আশা করি, এই অতিমারির অবসান ঘটে গেছে। আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের ‘নববর্ষে’ কবিতার ভাষায় বলি:
ওই এল এ জীবনে নূতন প্রভাতে
নূতন বরষ—
মনে করি প্রীতিভরে বাঁধি হাতে হাতে,
না পাই সাহস।
নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু—
এসো এসো নূতন দিবস!
ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে
আজিকার মঙ্গলকলস।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক