রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতাটা যে বাংলাদেশের জন্য চিরন্তন এবং সর্ব যুগোপযোগী, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
প্রথমে কবিতাটার কাহিনি আমরা আরেকবার স্মরণ করি।
হবু রাজা বললেন গবু মন্ত্রীকে, কাল সারা রাত আমি ভেবেছি, ধরণিতে চরণ ফেলা মাত্র কেন মলিন ধুলা পায়ে লাগে! জগৎ থেকে ধুলা দূর করো।
তখন সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও টক শোবিদদের ডাকা হলো। সভা-সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠক, কর্মশালা হলো। অনেক পিপে নস্য শেষ করে সিদ্ধান্তে আসা গেল, সমগ্র পৃথিবী ঝাড়ু দিয়ে ধুলা দূর করতে হবে।
শুরু হলো রাজ্যব্যাপী ঝাড়ু দেওয়া কর্মসূচি। তখন ধুলায় আকাশ গেল ঢেকে, দিনের বেলায়ও চারদিক অন্ধকার। সবার নাক বন্ধ, চোখ বন্ধ, সর্দি-কাশিতে অবস্থা খারাপ। রাজা বললেন, ‘করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর।’ তখন আবার বিশেষজ্ঞরা সভা-সেমিনার-কর্মশালা করলেন। এবার ঠিক করা হলো, পানি সেচে ধুলা দূর করতে হবে। ভিস্তিওয়ালারা পানি সেচতে শুরু করল। নদনদী শুকিয়ে মারা যেতে লাগল মাছ, আর ডাঙা ডুবে গেল জলে-কাদায়, সর্দি-জ্বরে দেশটা উজাড় হওয়ার উপক্রম। রাজা বললেন, এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা।
আবার সবাই বসলেন পরামর্শসভায়। এবার সিদ্ধান্ত হলো, চামড়া দিয়ে দুনিয়াটা ঢেকে দিতে হবে। চামারদের ডাকা হলো।
চর্মকারপ্রধান বললেন, ভয়ে ভয়ে একটা কথা বলি। পুরাটা পৃথিবী চামড়া দিয়ে ঢাকবেন, এত চামড়া কোথায় পাবেন? আর চামড়া দিয়ে সব মাটি ঢেকে ফেললে ফসলই-বা ফলবে কোথায়? তার চেয়ে একটা কাজ করুন। নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণি আর ঢাকিতে নাহি হবে। আসেন, রাজামশাই, আপনার পা দুটো চামড়া দিয়ে ঢেকে দিই। তাহলেই আর আপনার পায়ে ধুলা লাগবে না।
তা-ই করা হলো। রাজার দুই পা চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। সেই চামড়ার তৈরি পা-ঢাকনা জুতমতো পরা যায়, আবার খুলেও রাখা যায়। রাজা বললেন, বেশ জুতসই হয়েছে।
রাজা যখনই বেরোবেন, তখন তিনি বলেন, পায়ে চামড়া জোতো। (এই অংশগুলো রবীন্দ্রনাথের নয়, এই লেখকের কল্পনা)। ঠিকমতো জোতা হলো বলে নাম হলো জুতা।
রাজা বললেন, দারুণ হয়েছে। শুধু গরমের দিনে গন্ধটা যদি...
মন্ত্রী বললেন, মহারাজ, আপনার জুতার গন্ধ, এ তো মৃগনাভির চেয়েও সুরভিত। (এই লেখকের কষ্টকল্পনা)
এই হলো জুতা আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত কাহিনি, যা আমি আমার মনের মাধুরী খানিকটা মিশিয়ে পরিবেশন করলাম।
এখন বাংলাদেশেও চলছে প্রাক্-জুতা আবিষ্কারের যুগ।
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমাদের পুলিশকর্তারা বলছেন, যাঁর নিরাপত্তা তাঁকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ঘর পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই যাঁর ঘর, তিনিই পাহারা দিন।
এখানেই দরকার সেই বৃদ্ধ চর্মকারকে। যিনি বলবেন, মাননীয় মন্ত্রীমশাই, মাননীয় পুলিশ পরিদর্শক সাহেব, একটা কথা বলি। নিজের দুটি চরণ ঢাকুন, দুনিয়াটা ঢাকতে হবে না। আপনারা তো জেনেই গেছেন, কারা কারা এই খুন করে, তাদের নাম-ঠিকানা আপনারা উদ্ধার করে ফেলেছেন এবং কারা তাদের নির্দেশ দিচ্ছে, তাও আপনারা জানেন। এমনকি ঘাতকেরা কেন করছে এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, কেন চালাচ্ছে এই চাপাতি অভিযান, আপনারা তাও জানেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এবং বর্তমান জনপ্রিয় সরকারকে অজনপ্রিয় করাই এই দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্য। আসলে বর্তমান সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে চিহ্নিত মহল এই সব কাণ্ড ভাড়াটেদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। তাহলে সবই চিহ্নিত। কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে, কারা পরিকল্পনা করছে, কারা টাকা দিচ্ছে, কারা মদদ দিচ্ছে, কারা নির্দেশ দিচ্ছে, কারা পরিকল্পনা করছে, কারা ঘটনায় অংশ নিচ্ছে—সব আপনাদের জানা হয়ে গেছে। তাই যদি হবে, তাহলে ওই চিহ্নিত মহলকে নিশ্চিহ্ন করলেই হয়। যারা যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যারা পয়সা দিচ্ছে, যারা ইন্ধন দিচ্ছে, তাদের ধরে ফেলুন। এবং দেশবাসীকে জানিয়ে দিন, এরা এরা, অমুক অমুক এসবের পেছনে ছিল। এই যে দেখো ওদের ধরে ফেলেছি। বিচার করছি। শাস্তি দিচ্ছি। ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করছি। তাহলে আর ঘরে ঘরে গিয়ে আপনাকে পাহারা দিতে হবে না।
বন থেকে যদি একটা মানুষখেকো বাঘ জনপদে ঢুকে পড়ে, তাহলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার দুটো উপায় আছে। একটা হলো, সবাই ঘরে বন্দী থাকা। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা। জানালা দিয়ে বাইরে না তাকানো; আর কখনোই হাত-পা জানালার বাইরে না আনা। আরেকটা উপায় হলো ওই বাঘটাকে ধরে ফেলা এবং খাঁচায় পুরে ফেলা।
>রাষ্ট্র চাইলে পারে না, এটা বোকাও বিশ্বাস করে না। কিন্তু তাঁরা কেন চান না, সেটাই প্রশ্ন। তাঁরা ভাবছেন, কিছুই ঘটছে না। সব স্বাভাবিক আছে। এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সংবাদ
বস্তুত, বোতলবন্দী দৈত্য এখন বেরিয়ে পড়েছে। তাকে এখন বোতলে ভরতে হবে। এ না হলে আরেকটা উপায় আছে, রাজ্যের সব মানুষকে বোতলে ভরে ফেলতে হবে। আপনারা দ্বিতীয় পদ্ধতিটা অবলম্বন করতে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন। আপনারা সবাইকে বলছেন, বোতলে ঢুকুন, বোতলে ঢুকুন। কিন্তু আপনাদের চেষ্টা থাকা উচিত ছিল দৈত্যটাকে বলা, বাবা, তুমি যদি এতই পারো, আবার বোতলে ঢুকে দেখাও তো দেখি, কত তোমার শক্তি! জানা কথা, আজকের দৈত্য অত বোকা নয়। বললেই সে বোতলে গিয়ে ঢুকে পড়বে না। কাজেই তাকে ছলে-বলে-কৌশলে বন্দী করতে হবে।
করতে হবে বটে, তবে করবে কে? তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, চলাচলের অধিকার, বাক্স্বাধীনতা রক্ষা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। রাষ্ট্রকেই তা করতে পারতে হবে।
রাষ্ট্র চাইলে পারে না, এটা বোকাও বিশ্বাস করে না। কিন্তু তাঁরা কেন চান না, সেটাই প্রশ্ন। তাঁরা ভাবছেন, কিছুই ঘটছে না। সব স্বাভাবিক আছে। এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সংবাদ। সরকার যদি বলত, বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি, এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধ ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিবিধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তাহলেও একটা সান্ত্বনা ছিল। কিছু যে ঘটছে, তা তো কর্তারা স্বীকারই করছেন না। এটাকে বলে ডিনায়াল সিনড্রোম। এর চেয়ে হতাশাজনক আর কিছুই হতে পারে না। অযোগ্যতাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু অস্বীকৃতিকে আপনি কী বলবেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।