Thank you for trying Sticky AMP!!

টাকা পাচার, বেগমপাড়া ও দুদককে যা করতে হবে

গত ১৮ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ঢাকার এক সেমিনারে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া সম্পর্কে জানালেন যে ওখানকার ২৮ জন বাড়িমালিকের অধিকাংশই সরকারি কর্মকর্তা, চারজন রাজনীতিবিদ এবং কয়েকজন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক ও ব্যবসায়ী।
তাঁর বক্তব্যের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমদ সোহেলের আদালত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং আরও ছয়টি সরকারি সংস্থার ওপর রুল জারি করেন যে ১৭ ডিসেম্বর এহেন ‘মানি লন্ডারারদের’ তালিকা আদালতে পেশ করা হোক। বিচারপতিদ্বয় পুঁজি পাচারকারীদের ‘জাতির দুশমন’ হিসেবে অভিহিত করেন। দুদক ও চারটি সংস্থার পক্ষ থেকে ১৭ ডিসেম্বর আদালতে ১০০ জন পুঁজি পাচারকারীর নামের তালিকা এবং পাচারকৃত আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি ফর্দ পেশ করা হয়। কিন্তু আদালত এই উপস্থাপনায় অবহেলা রয়েছে মন্তব্য করে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখের মধ্যে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজি পাচারকারী এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পেশ করার নির্দেশ দেন।
বলা বাহুল্য, ১৭ ডিসেম্বর ১০০ জনের যে তালিকা উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে বাস্তবতার প্রতিফলন ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ( প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা) পুঁজি বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, অথচ দুদক তালিকা দিয়েছে মাত্র আড়াই হাজার কোটি টাকার!

পুঁজি পাচারের প্রধান চারটি পদ্ধতিও জিএফআই চিহ্নিত করেছে: ১) আমদানি বাণিজ্যে ব্যাপক ওভার-ইনভয়েসিং, ২) রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার-ইনভয়েসিং,৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে পাচার এবং ৪) হুন্ডি প্রক্রিয়ায় ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার। বিশেষত, ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণে হুন্ডি পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার সাম্প্রতিককালে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় ব্যাংকঋণ পাচারকে নাটকীয় হারে বাড়িয়ে চলেছিল। দেশের বৃহৎ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলায় করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত করার পূর্বে এ কারণেই ব্যাংকঋণ পাচার মহাসংকটে পরিণত হয়েছিল। (২০২০ সালের মার্চ থেকে হুন্ডি পদ্ধতি ঝিমিয়ে পড়ায় বৈধপথে দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহে অভূতপূর্ব স্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।) খেলাপি ঋণের সিংহভাগ যেহেতু বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, তাই এসব খেলাপি ঋণ কখনো ব্যাংকগুলোতে ফেরত আনা যাবে না। যাঁরা ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের’ দমন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরাই গোষ্ঠীপ্রীতির কারণে উল্টোপাল্টা নীতি নিয়ে খেলাপি ঋণ সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলছেন। এ জন্যই দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও নানা কায়দাকানুনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ল্যাসিফায়েড ঋণের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিমাণকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা দেখাচ্ছেন।

যেসব ব্যাংকঋণ গ্রহীতার নাম তালিকায় থাকবে, তাঁদের অবিলম্বে সব ব্যাংকের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাংকঋণ থেকে স্থায়ীভাবে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। তাঁরা ঋণখেলাপি হলে তাঁদের ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের সুযোগ রদ করতে হবে।

সবার মনে রাখতে হবে, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের অধিকাংশই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’, তাঁদের ঋণ ফেরত দেওয়ার পথে ফিরিয়ে আনা যাবে না। এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকঋণের উল্লেখযোগ্য অর্থ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন, বিদেশে তাঁরা ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কিনে অভিবাসন নিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা বিদেশে বসবাস করছেন, তাঁরা নিজেরাও বিদেশে যাওয়া-দেশে আসা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি বজায় রেখে পুঁজি পাচার করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কিংবা দুর্নীতি দমনের জন্য সরকার সত্যি সত্যিই ব্যবস্থা নিলে তাঁরা দেশ ত্যাগ করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও হাইকোর্টের রুল বিলম্বে হলেও সমস্যাটিকে জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
দুদক যদি সত্যিকারভাবে পুঁজি পাচার মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের দূতাবাস বা হাইকমিশনকে পত্র দিয়ে পুঁজি পাচারকারীদের তথ্য সংগ্রহের যে প্রয়াস চালাচ্ছে, তা বদলাতে হবে। বাংলাদেশের কয়েক শ ‘রবার ব্যারন’ পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের প্রধান হোতা হলেও হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ এবং ‘ব্যাংকঋণের সন্তান গার্মেন্টস মালিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতি’ প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে কয়েক লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ পুঁজি পাচার করে এসব দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব, গ্রিন কার্ড, পারমানেন্ট রেসিডেন্টশিপ বাগিয়েছে। টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’ কিংবা মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারের প্রতীকী গন্তব্য হিসেবে ইদানীং বহুল প্রচারিত হলেও ওপরে উল্লিখিত সব দেশেই ব্যাপকভাবে ঘাঁটি গেড়েছে এ দেশের ‘পুঁজি পাচারকারী সাহেবরা’। দুদকের নিজস্ব তদন্ত টিম অথবা গবেষণা টিম সরাসরি এসব দেশে পাঠিয়ে এই পুঁজি পাচারকারীদের ‘সুলুক সন্ধান’ খুব ব্যয়বহুল হবে কি?

‘পুঁজি পাচারকারী সাহেবদের’ দেশের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সদিচ্ছা বা সামর্থ্য সরকারের আছে কি না অথবা পাচারকৃত পুঁজি দেশে আদৌ ফেরত আনা যাবে কি না, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও যথাযথ অগ্রাধিকারসহকারে এদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে সরকারিভাবে প্রকাশ করলে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে:
১. যেসব চাকরিরত সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার এবং অন্যান্য ধরনের সরকারি কর্মকর্তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে, অবিলম্বে তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করা যাবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের চাকরিচ্যুতি, জেল-জরিমানা এবং সম্পত্তি ক্রোকের মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা যাবে।
২. যেসব ব্যাংকঋণ গ্রহীতার নাম তালিকায় থাকবে, তাঁদের অবিলম্বে সব ব্যাংকের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাংকঋণ থেকে স্থায়ীভাবে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। তাঁরা ঋণখেলাপি হলে তাঁদের ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের সুযোগ রদ করতে হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত কিংবা উচ্চতর আদালতে ঋণখেলাপের মামলা চলমান থাকলে একটি ‘ঋণখেলাপি বিচার ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ওই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান করতে হবে।
৩. ‘রাইট-অফ’ করা খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের নাম ঋণ পাচারকারীর তালিকায় থাকলে উক্ত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অবিলম্বে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৪. ব্যাংকমালিকের বা ব্যাংকের পরিচালকের নাম তালিকায় থাকলে তাঁদের ওই মালিকানা বা পরিচালনা বোর্ড থেকে অবিলম্বে অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের বিচারে সোপর্দ করা যাবে।
৫. যেসব রাজনীতিবিদের নাম পুঁজি পাচারকারীর তালিকায় থাকবে, তাঁদের মন্ত্রিসভা এবং দলীয় নেতৃত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে। সংসদ সদস্যদের নাম তালিকায় থাকলে, তাঁদের সদস্যপদ স্থগিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। তালিকায় নাম থাকলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করতে পারবে।

মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।