ঢাকার ঘোলাটে আকাশ
শীত-ভোরে সূর্যের কুয়াশাচেরা তেরছা আলোয় ভ্রু কুঁচকে অনিচ্ছায় চোখ মেলার আয়াস এখন ঢাকাবাসীর জন্য সুখময় অতীত কিংবা বর্তমানের বিলাস-ভাবনা। তার মাথার ওপর সব সময় ভীষণ বাস্তব হয়ে বিরাজে ঢাকার ঘোলাটে আকাশ। যেন একটা ঢাল, সূর্যের আলো ঠেকিয়ে দেওয়াই যার একমাত্র কাজ। রাজধানী ঢাকার আকাশ সত্যিই কিছুদিন ধরে ঘোলাটে হয়ে আছে। সূর্যের দেখা নেই। দেখা মিললেও তাতে মিশে থাকছে বিষণ্ন ভাব। না, শুধু শীতের কুয়াশার কারণে এমনটা হচ্ছে না। এটা এমনকি কুয়াশাও নয়। এর নাম ধোঁয়াশা; ইংরেজিতে ‘স্মগ’, যা ঢাকার দূষিত বাতাসের এক ভয়াবহ মূর্তায়ন।
বায়ুদূষণের তালিকায় গত সপ্তাহজুড়েই শীর্ষে অবস্থান করেছে ঢাকা। চীনের বেইজিং, ভারতের দিল্লিসহ আরও কিছু শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাঝেমধ্যে কিছু সময়ের জন্য পিছু হটতে হলেও শেষতক শীর্ষস্থানটি ঠিকই নিজের করে নিয়েছে ঢাকা। আক্ষরিক অর্থেই এ এক ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’। গত এক সপ্তাহে ঢাকার বাতাসে যতটা দূষণ দেখা গেছে, তা গত পাঁচ বছরেও দেখা যায়নি বলে মনে করা হচ্ছে। না, বায়ুদূষণের দিক থেকে শীর্ষ শহরের তালিকায় ঢাকা এবারই প্রথম ওঠেনি। আগেও এই স্থান দখল করেছিল। এবার যে বিষয়টি আলাদা তা মাত্রাগত।
বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, এবারের শীত মৌসুম ভীষণ বাজে হতে পারে। এত সতর্কতা সত্ত্বেও শুষ্ক মৌসুমের সম্ভাব্য বায়ুদূষণ নিয়ে আগে থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অথচ করোনা তো এই দেশে গত মার্চ থেকেই ভীষণ রকম বাস্তব
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর ঢাকার বায়ুমান ছিল ২০১ একিউআই। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ঢাকার বাসিন্দাদের মাস্ক পরে চলাফেরা করতে, দূষিত বাতাস থেকে ঘরকে রক্ষা করতে জানালা বন্ধ রাখতে এবং বৃদ্ধ ও শিশুদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে চলাচল না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর দুদিন আগে ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাতাসের মান ছিল আরও খারাপ। এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী সেদিন ঢাকার বায়ুমান ছিল ২৪৫ একিউআই, যা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, গবেষকেরা বলছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আট দিন (দিনের বেশির ভাগ সময়) ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।
প্রতিবছরই হেমন্ত থেকে ঢাকার বায়ুর মান খারাপ হতে থাকে, শীতে তা চরমে পৌঁছায়। এটা এখন প্রতিবছরের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর স্থায়ী সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গত বছরের একই সময়ে এই সংকট নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠন করতে উচ্চ আদালতের আদেশ এলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সে কমিটি গঠন করে। কিন্তু তাদের করা সুপারিশ অনুযায়ী কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ
এখনো দেখা যায়নি। গঠিত ১৬ সদস্যের কমিটি বায়ুদূষণের যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে, তা মোটাদাগে সবারই জানা।
চিহ্নিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটার বিস্তার, সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজ, নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা ইত্যাদি। কিন্তু এখনো এসব রোধের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযানের খবর জানা যায়, কিন্তু ঢাকার চারপাশসহ সারা বাংলাদেশেই পরিবেশ সুরক্ষা নীতি না মেনেই অবিরাম ইটভাটা গড়ে উঠছে। নির্মাণকাজের প্রশ্ন উঠলে সবার আগে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে হয় সরকারি নির্মাণকাজগুলোকেই। ঢাকার মেট্রোরেলসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ রোধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না। সড়ক মেরামতের কাজ এবং বিভিন্ন সরকারি সেবা সংস্থার পরিচালিত নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রেও বায়ুদূষণ এড়ানোর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত ফেলে রাখার বিষয়টি তো একেবারে গা সওয়া হয়ে গেছে। এসবের সঙ্গে রয়েছে শীতে পথবাসী মানুষের শীত নিবারণের চেষ্টায় কাগজ, ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া, যা ভীষণ ক্ষতিকর। প্রতি শীতে অসহ্য বায়ুদূষণের প্রসঙ্গটি সামনে এলেই কর্তৃপক্ষের ‘পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে’ ধরনের বক্তব্য ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য একটা তামাশা হয়ে উঠেছে।
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর এমন বাস্তবতা আজকের নয়। এমন নয় যে এসবের কারণ চিহ্নিত হয়নি। সবই হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। প্রতি শুষ্ক মৌসুমে ‘ধুলার পাহাড়’ দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো হেলদোল থাকে না। অথচ থাকা উচিত ছিল।
বিশেষত এই করোনাকালে বায়ুদূষণের মতো বিষয় নিয়ে প্রশাসনিক জায়গা থেকেই নাগরিকদের উদ্দেশে সরাসরি কিছু বক্তব্য থাকা উচিত ছিল। কারণ বায়ুদূষণে যে ফুসফুস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই ফুসফুসই করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় টার্গেট। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ আবার বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, এবারের শীত মৌসুম ভীষণ বাজে হতে পারে। এত সতর্কতা সত্ত্বেও শুষ্ক মৌসুমের সম্ভাব্য বায়ুদূষণ নিয়ে আগে থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অথচ করোনা তো এই দেশে গত মার্চ থেকেই ভীষণ রকম বাস্তব। তাহলে কেন নেওয়া হয়নি, কেন এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না—এই প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসছে। আরও যে প্রশ্ন হলো এই পরিস্থিতিতেও বায়ুদূষণ ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো স্বাস্থ্য নির্দেশনা সরকারি তরফ থেকে এল না কেন? চিরায়ত রেকর্ড শোনার বদলে কিছু তৎপরতা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য কি হবে মানুষের? যদি তা না হয়, তবে সামনের কয়েক মাস অনেক বড় বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।
● ফজলুল কবির লেখক ও সাংবাদিক
fazlul.kabir@prothomalo.com