দুর্নীতি ও লুণ্ঠন

তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে

যে জাল যত অদৃশ্য, সেই জাল তত শক্তিশালী। যেমন কারেন্ট জাল। এই জালে মলা-ঢেলার মতো মিহি মাছ থেকে শুরু করে রাঘববোয়াল সবই আটকায়। সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিতেও এমন সূক্ষ্ম জাল পাতা আছে। নড়তে–চড়তে গেলেই সেই জালের বাধা টের পাওয়া যায়। সেই জালের কাজও আপনি সবখানে টের পাবেন।
রাজধানীর মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গত শুক্রবার রাতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে রিজভী হাসান ওরফে বাবু নামে যুবলীগের এক কর্মী খুন হন। স্বজনের অভিযোগ, ওই দুর্বৃত্তরা নিহতের দলেরই লোক। অর্থাৎ উভয়ই একই সংগঠনের একই জালের একেকটা গিট্টু। একজনের মৃত্যুতে জালের একটা গ্রন্থি ছিঁড়ল বটে। তবে অন্য কেউ শিগগিরই সেই ছেঁড়া সুতাটায় জোড়া লেগে ক্ষমতার জালের অংশ হবেন। এভাবে জালটা অটুট থাকে। ব্যক্তি চলে যায়, কিন্তু জাল থেকে যায়। দলীয় বন্ধনে বাঁধা এই জাল ছিন্ন করে সাধ্য কার?
বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে পাচার হয়েছে ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা (প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫)। ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। টাকা তো আর ব্যাংকের ভল্টে ডাকাতি করে বের করা হয়নি। করা হয়েছে প্রকাশ্যেই, কাগজপত্রের মাধ্যমে। বৈধ পদে বসে থাকা বৈধ লোকদের মাধ্যমেই টাকাটা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেলেও তা সাগরেও ডোবেনি, কিংবা মাটির নিচে কলসে করে লুকিয়েও রাখা হয়নি। এসব টাকা দেশে বা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকেছে, বাজারে খরচ হয়েছে, জমি-ফ্ল্যাট-গাড়ি কিনতে লেগেছে। কিছুটা দেশে কিছুটা বিদেশে।
এত টাকা নির্বিঘ্নে লুটে নিতে বিরাট বড় জাল লাগে। সেই জালের রশি থাকা লাগে ক্ষমতার সিঁড়ির উঁচু কোনো ধাপে। তদন্তে বা খবরের কাগজে দায়ীদের দু–একজনের নাম আসে। দু–একজন কিছুকাল হাজতের মোটা চালের ভাত খান। কিন্তু পুরো জাল অটুট থেকে যায়। আর অটুট থাকে বলেই তার কাজ করে যেতে পারে। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের কথায় সুবীর নন্দীর কণ্ঠে সিনেমার একটা গান ছিল, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে। কারবা এমন সাধ্য আছে এই মায়া জাল ছিঁড়ে যেতে পারে।’ আজতক এই সাধ্য কারও হয়েছে বলে জানা নেই।
এই জালের কথা বলা হয়েছিল ‘দ্য নেট’ নামের এক গবেষণায়। ১৯৭৯ সালে সাহায্য সংস্থা ব্র্যাকের কর্মীরা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জরুরি ত্রাণ দিতে গিয়ে সেখানকার ক্ষমতাকাঠামোয় ধাক্কা খান। সমস্যাটাকে বুঝতে ব্র্যাকের একদল গবেষক গ্রামাঞ্চলে কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি সাহায্য, খাসজমি, ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে শুরু করে সহায়-সম্পত্তি বেহাত হয়, তা বুঝতে নামেন।

>এই জাল ছিন্ন না করেই জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে, একটা ন্যায্য ও সভ্য সমাজ আমরা পেয়ে যাব? এর কোনো বাস্তব উত্তর সরকার দেয় না। আমাদের দেশের নেতা–নেত্রীরা সব সম্ভাবনা আগে স্বপ্নে দেখে থাকেন। সম্ভবত, এই রাজনৈতিক দস্যুবৃত্তি থেকে দেশকে মুক্ত করার চিন্তা তাঁরা স্বপ্নেও করেন না। যদি কেউ সেটা ​তাঁদের দেখান, তাঁরা ভাবেন এ কী দুঃস্বপ্ন রে বাবা!

তাঁরা উত্তরবঙ্গের সীমান্ত এলাকার ১০টি গ্রামের ওপর কাজ করে দেখেন, গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে দারুণ এক জাল তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন একদল সুবিধাভোগী গ্রামবাসী ও মাস্তান। অনেক সময় তাঁরা আপসে গরিবদের প্রাপ্য সম্পদ ও সুবিধাগুলো তছরুপ করেন। কখনোবা এ জন্য অনুগতদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজকারবারও করিয়ে নেন। এই জালের মধ্যে আছেন পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারাও। ভূমি দখল ও জনগণের জন্য প্রাপ্য সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল এই জালের প্রধানতম কাজ। এককথায় এটা ছিল টাকা বানানোর জাল।
তারপর প্রায় সাড়ে তিন দশক পার হয়েছে। ক্ষমতার এই জাল এখন আরও ব্যাপক আরও শক্তিশালী। কারেন্ট জালের মতো জনগণের জীবনের সকল অংশই ধরা আছে এই জালের আওতায়। এই জালের ওপর আরেকটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন তিনজন গবেষক: হাসান মনজুর, মুহাম্মদ জাকারিয়া ও জোনাথন রোজ। ‘দ্য রিয়াল পলিটিকস অব বাংলাদেশ’ নামের এই গবেষণা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। গবেষকেরা স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধের চরিত্র, সেগুলোর হোতাদের পরিচয় বিশ্লেষণ করেছেন। তারপর এর সঙ্গে সরকারি রাজনৈতিক দলের যোগাযোগটা ধরেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের সদস্যদের সম্পদ, জমি, সোনা ও আয়ের বৃদ্ধির হিসাবও তাঁরা করেছেন। এর সঙ্গে যাঁরা ২০১৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের সম্পদ ও আয়েরও তুলনা করেছেন। যদিও নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সম্পদ ও আয়ের বিবরণীকে সত্য বলে ধরে নেওয়া কঠিন। তাই তাঁরা বেশ কজন সাংসদের এলাকায় নিজেরা জরিপ চালিয়েছেন। সাতটি বিভাগের প্রতিনিধিত্বশীল এলাকার ৩৪০ জন সাংবাদিকের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন।
তাঁরা দেখেছেন, বাংলাদেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে লাভের উদ্দেশ্যে প্রধান অপরাধ হলো ভূমি দখল। ভূমি দখলের সঙ্গে জড়িত অপরাধ ঢাকায় ৯৫.৮%, চট্টগ্রামে ৯২.২%, সিলেটে ৯০.৪% ও বরিশালে ৭৪.১%। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের প্রধান অপরাধমূলক কাজ হলো মাদক ব্যবসা। মূলত সব বিভাগেই তাঁরা তিন ধরনের অপরাধ বেশি পেয়েছেন: ভূমি দখল, মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজি অথবা চুরি। রাজনৈতিক দলের মাস্তানরা এগুলো করে আর তাদের পিঠ বাঁচে রাজনৈতিক
ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায়। সারা দেশেই সবচেয়ে লাভজনক অপরাধের এক নম্বরে পাওয়া যায় ভূমি দখল এবং দুই নম্বরে আছে মাদকের বেআইনি কারবার।
তাঁরা আরও দেখেছেন, সব বিভাগেই ভূমি দখল ও মাদকের কারবারে জড়িতদের সারির প্রথমে আছেন রাজনৈতিক দলের নেতা, দ্বিতীয়তে যুবনেতা এবং তৃতীয়তে আছেন পুলিশ অথবা সরকারি কর্মকর্তা। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির উৎস যে সরকারি ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ড বিতরণ, সেখানেও জড়িত রাজনীতিবিদ, যুবনেতা ও সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি কাজের বরাদ্দের সুবিধাভোগীও এই তিন ধরনের লোক। তাঁরা ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের আগের তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায়ও রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও যুবনেতা ও মাস্তানদের হাত দেখতে পেয়েছেন। এই মাস্তানশক্তির দাপট সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ঢাকায়, তারপরে রয়েছে খুলনা। ছাত্র-যুব ও মাস্তান নেতা বলতে অনেক ক্ষেত্রেই একই ধরনের ব্যক্তিদের পাওয়া যায় বলে এই তিন চরিত্রকে আমরা এককথায় সন্ত্রাসী ছাত্র-যুবনেতা বলতে পারি।
ভূমি দখলের বেলায় প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদেরা এক নম্বরে হলেও মাদক ব্যবসার মূলে রয়েছে সন্ত্রাসী যুব ও ছাত্রনেতারা। সাতটি বিভাগেই দেখা গেছে এঁদের কোনো পেশা নেই, মাদক ও মাস্তানিই তাঁদের ক্ষমতা ও টাকার উৎস। সাতটি বিভাগেই এঁদের ৫৬ থেকে ৮৯ শতাংশ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাশালী পদ আলো করে আছেন। এবং শেষ কথা এই, বিভিন্ন বিভাগে এই মাস্তানদের ৭৩ থেকে ৯০ শতাংশই বড় রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয় পান। এবং এঁদের বেশির ভাগই হত্যাসহ ফৌজদারি অপরাধে জড়িত বলে দেখা গেছে।
দৃশ্যত টাকা বানানোর জাল আর ক্ষমতার জাল নিজেদের আলাদা দেখাতে চায়। বিরল ব্যক্তিদের বাদ দিলে প্রায় সব নেতাই ব্যবসায়ী৷ সংসেদও তাঁরাই দলে ভারী। রাজনীতি এখন দ্রুত বড়লোক হওয়ার মাধ্যম৷
জেলা পর্যায়ের সরকারি ক্ষমতা থাকে মূলত সাংসদদের হাতে। তাঁরাই সেখানকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার চাবিকাঠি। এই গবেষণা দেখাচ্ছে, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সাংসদদের সম্পদ ও আয় বেড়েছে ৩২৪ শতাংশ। এটা যদিও প্রকৃত আয় নয়, তবু পাঁচ বছরে প্রদর্শিত আয় তিন গুণ বাড়া দিয়েই বোঝা যায়, লুকানো আয় কত বেশি হতে পারে! উল্লেখ্য, এই সময়ে প্রদর্শিতভাবে তাঁদের ভূসম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির হার। এটা প্রায় ২ হাজার ৮০০ গুণ!
এই সব মিলিয়েই যে জাল তার মধ্যেই চলছে বাংলাদেশের জনগণের জীবন। এটাই বাংলাদেশের মানুষের গলায় পরানো মণিহার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এই মণিহার পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে। একে ছিন্ন না করেই জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে, একটা ন্যায্য ও সভ্য সমাজ আমরা পেয়ে যাব? এর কোনো বাস্তব উত্তর সরকার দেয় না। আমাদের দেশের নেতা–নেত্রীরা সব সম্ভাবনা আগে স্বপ্নে দেখে থাকেন। সম্ভবত, এই রাজনৈতিক দস্যুবৃত্তি থেকে দেশকে মুক্ত করার চিন্তা তাঁরা স্বপ্নেও করেন না। যদি কেউ সেটা তাঁদের দেখান, তাঁরা ভাবেন এ কী দুঃস্বপ্ন রে বাবা!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com