Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন যুদ্ধে পড়েছে শ্রীলঙ্কা

খাদ্যসংকটে পড়া শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের জন্য দোকানে মানুষের ভিড়

নিজেদের রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার দিচ্ছে বাংলাদেশ। তার দুই কিস্তি দেওয়া হয়েছে আগস্টে। শ্রীলঙ্কা নিজেদের মুদ্রা জমা রেখে এ ডলার নিচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় এটা মুদ্রার বিনিময় বা ‘কারেন্সি সোয়াপ’। গতানুগতিক ঋণ বা ধার নয়।

তারপরও এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ‘ঋণদাতা’ দেশের তালিকায় উঠেছে। তবে উদ্বেগের কথা হলো, ঠিক এ সময় শ্রীলঙ্কায় খাদ্যসংকট সামলাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা, খাদ্যশস্য ছাড়াও নানা দিকে চাপে পড়েছে দেশটি।  তামিলদের সঙ্গে লড়ে জিতলেও সুশাসনের যুদ্ধে লঙ্কাবাসীর প্রাপ্তি অতি সামান্য। খাবারের খোঁজে মানুষকে রাস্তায় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে এখন। কয়েক বছর আগে এটা কল্পনা করা যেত না। এককালের সমৃদ্ধ দেশটি কেন ক্রমে এ রকম সংকটে পড়ছে—এ প্রশ্নের উত্তরে ভাষ্যকাররা ডলার-সংকটের কথা বলছেন। কিন্তু কেবল বিদেশি মুদ্রা শ্রীলঙ্কাকে রক্ষা করতে পারবে না। সংকটের গোড়ায় আছে গভীর রাজনৈতিক কারণ।

তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য নেই দেশটির
বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ডলার নিতে হয়েছে, কারণ তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা নেই তার হাতে। এখনকার সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, ২০১৯ সালের নভেম্বরে, দেশটিতে ডলারের মজুত ছিল সাড়ে সাত বিলিয়ন। গত জুলাইয়ে সেটা তিন বিলিয়নের নিচে নেমেছে। একই সময়ে ডলারের বিপরীতে রুপির দাম অন্তত ২০ শতাংশ পড়ছে। বিনিময়মূল্যে ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থায় আছে শ্রীলঙ্কার রুপি। ডলার ধরে রাখতে সরকার নানা জিনিসের আমদানি বন্ধ করেছে। এতে আমদানি পণ্যের দাম যাচ্ছে বেড়ে। বেড়েছে মজুতদারি। ওষুধসংকটের কথাও বলছে নাগরিকেরা।

সরকার ডলারের যে দাম বেঁধে দিয়েছে, সে দামে আসলে ডলার মিলছে না। এভাবে মুদ্রা-অর্থনীতি ক্রমে ঢুকে পড়ছে কালোবাজারে। সর্বশেষ, সরকার গাড়িচালকদের জ্বালানি কম ব্যবহার করতে বলছে। জ্বালানি আমদানি কমিয়ে সরকার হাতে থাকা ডলার দিয়ে খাদ্য আমদানি করতে চায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা আমদানি ব্যয় মিটাতে পারবে কি না, শেষ পর্যন্ত সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশের রপ্তানিকারকেরা নিশ্চিত নয়।

তামিলদের সঙ্গে লড়ে জিতলেও সুশাসনের যুদ্ধে লঙ্কাবাসীর প্রাপ্তি অতি সামান্য। খাবারের খোঁজে মানুষকে রাস্তায় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে এখন। কয়েক বছর আগে এটা কল্পনা করা যেত না। এককালের সমৃদ্ধ দেশটি কেন ক্রমে এ রকম সংকটে পড়ছে—এ প্রশ্নের উত্তরে ভাষ্যকাররা ডলার-সংকটের কথা বলছেন।

খাদ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে লঙ্কানদের
শ্রীলঙ্কা অতীতে খাদ্যসংকটে পড়েছিল শ্রীমাভো বন্দরনায়েক সরকারের সমাজতান্ত্রিক নিরীক্ষার কালে। সে সময় পরিস্থিতির সামলাতে ভর্তুকি দামে পণ্য পেতে ‘রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা চালু হয়। ওই ব্যবস্থা এখন আর নেই। অন্যদিকে, এখনকার মতো বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়েছিল লঙ্কানরা ১৯৫২ সালে একবার। তখন চীন থেকে চাল আমদানি করা হয় রাবারের বিনিময়ে। চলতি সংকটের মুখে বয়োজ্যেষ্ঠরা অতীতের এসব অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন নবীনদের। সাধারণভাবে খাদ্যশস্যের সংকটের সমাধানের ভালো রাস্তা হলো উৎপাদন, আমদানি ও বিতরণব্যবস্থা বহুমুখীকরণ। কিন্তু জরুরি আইনের আওতায় শ্রীলঙ্কার প্রশাসন জোর দিচ্ছে মজুতদারি ও কালোবাজারির বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে। ব্যবসায়ীদের হাত থেকে পণ্য নিয়ে বিতরণ করার চেষ্টা হচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীকে দিয়ে।

দেশটিতে ব্যবসায়ী সমাজে তামিল ও মুসলমান অনেক। এদের বিরুদ্ধে প্রতীকী কিছু অভিযান চালিয়ে খাদ্যসংকট থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো সহজ। প্রশাসন সেই সহজ কাজও করছে এই ফাঁকে। কিন্তু তাতে খাদ্যশস্য আরও উধাও হচ্ছে। বাজার থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দেশটির বিভিন্ন স্থানে দোকানপাটের সামনে কেবল লাইন আর লাইন। প্রশাসন চিনির দাম বেঁধে দিয়েছে কেজি ১২৫ রুপি। কিন্তু বাস্তবে গোপনে সেটা কিনতে হচ্ছে ২০০ রুপির বেশিতে। লঙ্কানরা সচরাচর চিনি বেশি খায়। তবে চালের দামেও একই অবস্থা। পেঁয়াজে অবস্থা বেশি খারাপ। জ্বালানি বাঁচাতে সরকার গাড়ি কম চালাতে বলায় পণ্য সরবরাহে আরও বিঘ্ন ঘটার শঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত, দুই কারণে এই খাদ্যসংকট—খাদ্য আমদানির মতো ডলারের অভাব ও কৃষি নিয়ে সরকারের একগুঁয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

অর্থনৈতিক সংকট জাতিবাদের হাত ধরে এসেছে
লঙ্কার চলতি সংকটের জন্য অনেক প্রচারমাধ্যম মহামারিকে দায়ী করছে। কোভিডের সময় পর্যটকেরা সেখানে বেড়াতে যায়নি, তাই ডলার মিলছে না—ব্যাখ্যাটা এ রকম। প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোতেও টান পড়েছে—এটাও সত্য। কিন্তু এসব বিবরণে সরলীকরণ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার সংকট মহামারির কারণে এগিয়ে এসেছে কেবল। সংকট আসন্নই ছিল। এই সংকটের উৎস বর্তমান শাসক পরিবারের শাসন সংস্কৃতি। গৃহযুদ্ধে তামিলদের কোণঠাসা করার পর দেশটিতে সমন্বয়বাদী রাজনীতির দরকার ছিল। ঘটেছে উল্টো। জাতিবাদ আরও উসকে দেওয়া হয়। কেবল তামিল নয়, মুসলমানরাও এখন সিংহলিদের কাছে ঘোরতর প্রতিপক্ষ। শেষোক্তদের সন্ত্রাসী ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে ২০১৯ সালের ইস্টার সানডে বোমা হামলাকে এত বেশি প্রচার করা হয়, দেশটিতে পর্যটক আসাই বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে করোনার আগেই রাজনীতিবিদেরা সংকীর্ণ স্বার্থে অর্থনীতির বড় ক্ষতি করে ফেলেন।

কৃষিতে সংকট হলো যেভাবে
দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অতীতে সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছেন এবং প্রতিরক্ষাসচিবও ছিলেন। তাঁর খ্যাতি মূলত তামিলদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে বেসামরিক প্রশাসনকে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন আর অর্থনীতি বা খাদ্যবাজার সামলানো ভিন্ন বিষয়। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট খাবার পরিস্থিতি সামলাতে সামরিক বাহিনীকে যত বেশি রাস্তায় নামাচ্ছেন, ততই পরিস্থিতি নাজুক হচ্ছে। এই লেখা তৈরির সাত দিন আগে প্রেসিডেন্ট ধান-চাল-চিনির বাজার সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন কোনো অর্থনীতিবিদকে নয়, ঊর্ধ্বতন সমরবিদ জেনারেল নিউনহেলাকে। এর আগে মহামারি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন আরেক সমরবিদ শভেন্দ্র সিলভাকে। বেসামরিক প্রশাসনের অনেক পদে প্রেসিডেন্ট এভাবে সামরিকায়ন করছেন। সংকটের মুখে সশস্ত্র বাহিনীকে কাছে রাখতে চান তিনি। প্রশাসনিক নানা পদক্ষেপে সমরবাদী মনোভাব প্রকট দেখা যাচ্ছে দেশটিতে।

সংকট আসন্নই ছিল। এই সংকটের উৎস বর্তমান শাসক পরিবারের শাসন সংস্কৃতি। গৃহযুদ্ধে তামিলদের কোণঠাসা করার পর দেশটিতে সমন্বয়বাদী রাজনীতির দরকার ছিল। ঘটেছে উল্টো। জাতিবাদ আরও উসকে দেওয়া হয়।

বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা হয়েছে কৃষি খাতে আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না। শ্রীলঙ্কাকে অরগানিক কৃষিতে বিশ্বে সামনের কাতারে রাখতে চান তিনি। কিন্তু তাৎক্ষণিক শতভাগ কৃষিতে ব্যবহারের মতো জৈবসার কোথায় পাওয়া যাবে এবং পাওয়া না গেলে খাদ্য উৎপাদনের কী হবে—এ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে অনেকে। সবার অনুমান, পুরো কৃষিকে জৈবসারনির্ভর করতে গিয়ে কৃষি উৎপাদন বেশ কমবে। অন্তত ধানের উৎপাদন কমতে বাধ্য। এটাই দেশটির প্রধান কৃষিপণ্য। ইতিমধ্যে চালের বাজার অত্যধিক চড়া। ধারণা করা হচ্ছে, অরগানিক সারের নিরীক্ষায় কমবে দেশটির চায়ের উৎপাদনও। দেশটির চা জগৎখ্যাত এবং বৈদেশিক মুদ্রারও বড় উৎস। সরকার সার নিয়ে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বলে মনে হয় না। সমরবাদী মানসিকতা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাকে সচরাচর পরাজয় হিসেবে দেখে। গোতাবায়া রাজাপক্ষের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

বিপুল বিদেশি দেনার ফাঁদে লঙ্কা
বর্তমান সরকারের বড় বন্ধু গণচীন। অতীতে বিস্তর ঋণ দিয়েছে তারা লঙ্কাকে। সব মিলে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলার দেনা এখন লঙ্কার। সুদে-আসলে এ বছরের দেনা শোধে এখনো প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার বাকি। নিকট ভবিষ্যতে কীভাবে শ্রীলঙ্কা এসব দেনা শোধ করবে, সেটা গভীর প্রশ্ন হয়ে আছে। রুপির মান পড়তে থাকলে ডলারের জোগান ক্রমে কঠিন হতে থাকবে। তামিলবিরোধী জাতিবাদী অবস্থানের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে দেশটির ঠান্ডাযুদ্ধ আছে। বাংলাদেশের মতো কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কাকে দেড় বিলিয়ন ডলার দিয়েছে চীন। ভারত দিচ্ছে ৪০০ মিলিয়ন। কিন্তু এসব দেশ ভবিষ্যতেও সহায়তা অব্যাহত রাখবে কি না, তা বলা মুশকিল।

সে রকম ঘটলে কলম্বোকে বড় অঙ্কের ঋণের জন্য আইএমএফের কাছে যেতে হবে। সেখানে অপেক্ষা করছে বেদনাদায়ক অর্থনৈতিক সংস্কারের দীর্ঘ এক ফর্দ, যা শ্রীলঙ্কার নাগরিক জীবনকে সামনের দিনগুলোয় দুঃসহ করে তুলতে পারে।

সংকটের কেন্দ্রে এক পরিবারের শাসন
চলতি অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে শ্রীলঙ্কার জনগণেরও কিছু দায় আছে। ভোটের সময় তারা সিংহলি জাতিবাদীদের এত বেশি করে ভোট দিয়েছে যে বিরোধী দল অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী (গোতাবায়া, মাহিন্দা, বাছিল) একই পরিবারের। তাঁদের আরেক ভাই চামালও মন্ত্রিসভার সদস্য। এই ভাইদের দুই ছেলেও (নামাল ও শশীন্দ্র রাজাপক্ষে) মন্ত্রিসভায় আছেন। এশিয়ার অনেক দেশ অতীতে এবং বর্তমানে একদলীয় বা প্রায়-একদলীয় শাসন দেখেছে। কিন্তু বর্তমান শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের শাসনের নজির এ অঞ্চলের ইতিহাসে বেশ বিরল।

যে সমরবাদী চরিত্রের জন্য এই রাজাপক্ষে পরিবারকে সিংহলিরা পছন্দ করেছে, সেই একই কারণে এখন অর্থনৈতিক অনাচার নিয়ে বেশি কথা বলতে পারছে না তারা। জরুরি অবস্থার মতো প্রেসিডেন্টের অনাকাঙ্ক্ষিত বিধান পার্লামেন্টে ৮১ ভোটের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হয়েছে। কিন্তু ‘জরুরি’ এই ক্ষমতার জোরে বিরোধী কণ্ঠকে যে আরও কোণঠাসা করা হবে, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। সব মিলে এক আত্মবিনাশী অবস্থার মুখে এককালের সমৃদ্ধ সিলন।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক