Thank you for trying Sticky AMP!!

নারী নির্যাতন মামলায় যত বাধা

বিচারাধীন কিছু মামলা দ্রুত সুরাহার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে নারী নির্যাতন মামলা নেই। দেশের প্রায় ১০ ধরনের ট্রাইব্যুনালে করা সব ধরনের মামলার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব থেকে বেশি স্থগিত থাকছে। বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১টি বিচারাধীন নারী নির্যাতন মামলার মধ্যে ৯৪৯টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। অবশ্য কেউ বলবেন, প্রতি ১৬৯টি মামলায় মাত্র একটি মামলা স্থগিত থাকা, এ আর এমন কি। আধা শতাংশের নিচে। আপাতদৃষ্টিতে পরিসংখ্যানটি নিরীহ, কিন্তু মোটেই তা নয়। আরও অনেক সূচকের মতো বিচারহীনতার দিক থেকে নারীরাই সব থেকে বেশি পিছিয়ে আছেন। একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

সারা দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা উচ্চ আদালতে যে হারে স্থগিত হয়, তার থেকে অনেক বেশি হারে নারীর মামলা স্থগিত হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার হার যথাক্রমে প্রতি ২১০টিতে এবং ২০৯টিতে একটি করে। আর নারী নির্যাতন মামলা স্থগিত হয় প্রতি ১৬৯টিতে একটি করে।

সারা দেশের সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, নারীদের মামলাগুলোর বিচার হতেই বেশি সময় লাগছে। প্রায় সাড়ে সাতটি ফৌজদারি মামলায় গড়ে একটি করে মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। অন্যদিকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় প্রতি চারটি মামলার মধ্যে একটি মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। এভাবে চারটি মামলার একটি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান থাকার মধ্যে অবশ্য দেওয়ানি মামলাও পড়ে।

হাইকোর্টে শুল্ক, মূসক, দুর্নীতি এবং সাম্প্রতিক কালে সিআরপিসির ৪৯৮ ধারার আওতায় মামলা বা পুরোনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি বিষয়ে নির্দিষ্ট বেঞ্চ আছে। কিন্তু নারীকে সুরক্ষা দিতে বিশেষ আইন এবং মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধান করা হলেও উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে সেভাবে যথাগুরুত্ব বা সংবেদনশীলতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

সুপ্রিম কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা ৯৫০টি স্থগিত থাকলেও নিশ্চিতভাবেই এর থেকে বহুগুণ বেশি হবে ‘উচ্চ আদালতে বিচারাধীন নারী নির্যাতনের মামলার’ পরিসংখ্যান। কিন্তু এই পরিসংখ্যান আলাদাভাবে রাখা হয় না, যা রাখা উচিত। ট্রাইব্যুনালগুলোর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পরে উচ্চ আদালতে নারী নির্যাতনের মামলাগুলোতে দণ্ডিতদের কীভাবে কারাবাস বা খালাসপ্রাপ্তি ঘটে, সেটা আমাদের জানা দরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও নারী সংগঠনগুলো এসব পরিসংখ্যান পেলে তারা নানা সমীক্ষা ও গবেষণা করতে পারে। ২০০০ সালে আইনে কঠোরতা আনার পর তার অভিজ্ঞতা ঠিক কী হয়েছে, সেই বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে একটি বড় ধরনের সংলাপ হওয়া দরকার।

২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে ২৩ মে সময়কালে প্রকাশিত প্রথম আলোর ছয় পর্বের একটি বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখানো হয়, দেশে সব অপরাধের মামলায় দণ্ডলাভের গড় হার ১৫ শতাংশের বেশি। অথচ ঢাকাতেই নারী নির্যাতনের গুরুতর ছয়টি অপরাধের মামলায় সাজার হার ৩ শতাংশের কম। এই পরিসংখ্যান কিন্তু প্রকারান্তরে নারীর মামলাতেই যে উচ্চ আদালতের স্থগিতকরণের হারটা বেশি, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার ৫৮টি ট্রাইব্যুনালে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান নারী নির্যাতন মামলার সংখ্যা ৩৭ হাজারের বেশি। ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮—এই তিন মাসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এটাও দেখা গেছে যে মামলা করার চেয়ে নিষ্পত্তির হার সামান্য বেশি। ওই ৯০ দিনে গড়ে প্রতিদিন ১৩০টি নতুন মামলা ও ১৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি যৌন হয়রানি বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় মামলা হয়, তা মনে করার কারণ নেই।

দেশের ৫৮ জেলায় পৃথক নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও ছয়টি জেলায় আলাদা ট্রাইব্যুনাল নেই। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪১ জেলায় ট্রাইব্যুনাল ছিল না। সুতরাং ২০০০ সালের আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান করা এবং তা রক্ষা করতে না পারার বিষয়ে কার্যকর কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা না রাখা থেকে আমরা কী বুঝব?

বিচার যত বিলম্ব, তত সাক্ষীর স্মৃতিভ্রম, প্রমাণের ক্ষয় ঘটে, কেউ মারা যান। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, ট্রাইব্যুনালের ৮০ শতাংশ (মতান্তরে ৫০ শতাংশ) মামলাই যৌতুকের (ধারা ১১ গ)। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে জখম থেকে হত্যা ৫ শতাংশের বেশি নয়। অথচ আইন যৌতুকসংক্রান্ত খুনের শাস্তি হিসেবে ‘শুধু মৃত্যুদণ্ড’ বলা আছে, দণ্ড এভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া বিচারকের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারবিরোধী। এ ছাড়া অপরাধের কতিপয় ধারা আপসযোগ্য, নতুন বিধিমালা তৈরিসহ সুপ্রিম কোর্টের প্রায় সব কটি সুপারিশের প্রতি সরকারের নির্লিপ্ততা অব্যাহত। এভাবে আমরা দেখি, নারীকে সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিগত ঔদাসীন্য চলমান।

নারীর জন্য আইন তৈরি ও তা প্রয়োগ খুব জটিল হয়ে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমীন একদা বলেছিলেন, এখানে মিথ্যা মামলা বেশি। সেটা অনুমেয়রূপে বিচার চলবে না,২০১৬ সালে সতর্ক করেছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. ইমান আলী। এই মিথ্যার বহুরূপ, যাতে সত্যও মিশ্রিত। এ মাসের গোড়ায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি মামলায় দেখলেন, যৌতুক মামলায় দণ্ডিত স্বামীর সঙ্গে তাঁদের শিশুসন্তানসহ সংসার করছেন বাদী। হাইকোর্ট আগামী ছয় মাসের মধ্যে আইন শুধরে ১১ গ-কে যথার্থই আপসযোগ্য করতে বলেছেন। তবে একই সঙ্গে একটি উদ্ভাবনীমূলক নির্দেশনাও দিয়েছেন। এর আওতায় ট্রাইব্যুনালগুলো এখন থেকে যৌতুকের মামলায় পক্ষগুলোর সম্মতিতে আপসরফাকে উৎসাহিত করতে পারবেন। তবে সংসদের উচিত হবে দ্রুততার সঙ্গে ২০০০ সালের আইনটি হালনাগাদ করা, কিন্তু তা না করে হাইকোর্টের এখতিয়ারের শুদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ কাম্য নয়।

মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান জানালেন, নুসরাতের বয়সী এক ভিকটিমের যৌতুকের মামলায় সম্প্রতি শাশুড়ি হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ পান। এর সুবিধা স্বামীও পাবেন। কারণ নিম্ন আদালতের নথিপত্র উচ্চ আদালতে এলে তখন স্বামীটির বিচারও আর চলবে না। ডিআইজির সাত সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা মামলায় পুলিশ তিনবার এফআরটি দিল। এলিনার চতুর্থ নারাজি টিকে যাওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট সিঙ্গাপুরে করানো প্রশ্নে বিচার স্থগিত থাকে। এলিনা বুঝলেন, বাইরে গেলে পালাবেন। সেই স্থগিতাদেশ রদ করিয়ে দেশেই ডিএনএ পরীক্ষা করানোর আদেশ পেতে তাঁর তিন বছর লেগেছিল।

প্রথিতযশা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মাসদার হোসেনের পরামর্শ পেলাম, ‘মামলা যখন যেমনই হোক, আমলে নেওয়ার আগেই নির্বাহী হাকিম দিয়ে মামলাগুলো ছেঁকে নিন।’ নারী নির্যাতন মামলা সর্বোচ্চ দ্রুততায় নিষ্পত্তি হলে সবার লাভ। নুসরাতের বিয়োগান্ত মৃত্যুর পরে সর্বসম্মত মত আসছে যে বিচারহীনতাই দুর্বৃত্তদের স্পর্ধা বাড়াচ্ছে। একজন নুসরাত হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলেও তা একমাত্র সমাধান নয়।

নুসরাতের করুণ মৃত্যু যত প্রশ্ন তৈরি করেছে, তার মীমাংসায় একটি উপযুক্ত উচ্চ বিচার বিভাগীয় উদ্যোগ সময়ের দাবি।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com