Thank you for trying Sticky AMP!!

পাগলা মলম ও আশ্বাসঘাতকতার গল্প

মলম যে কী মারাত্মক কাজের জিনিস, তা কারওয়ান বাজারে না গেলে বোঝা যাবে না। সেখানে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে মাইকে রেকর্ড করা লেকচার বাজিয়ে মাসের তিরিশ দিন এই জিনিস বিক্রি হয়। রানে, কানে, আঙুলের চিপায়–চাপায় থাকা খুঁজলি, চুলকানি, খোসপাঁচড়া, গোটাগাটি ঘা–পাঁচড়া থেকে শুরু করে দাদ, একজিমাসহ যাবতীয় চর্মরোগের মহৌষধ হিসেবে পাওয়া যায় ‘পাগলা মলম’। আর একমাত্র মনের ব্যথা ছাড়া দুনিয়ার অন্য সব পদের ব্যথা সারানোর জন্য পাওয়া যায় ‘শারমিন মলম’। কাটা, ফাটা, ছেঁড়া, থেঁতলানো—যেকোনো ব্যথায় ‘শারমিন মলম’ নাকি কোরামিনের মতো কাজ করে।

এক বন্ধু বলল, এই মলম সত্যিই নগদা-নগদি কাজ করে। চর্মরোগের জন্য যে মলম দেওয়া হয়, তাতে অ্যাসিড আছে। সেই অ্যাসিড ত্বকের ওপরের অংশ পুড়িয়ে দেয়। রোগী ভাবে চুলকানি সেরে গেছে। কয়েক দিন পরে আবার জায়গার জিনিস জায়গায় ফিরে আসে। একইভাবে ব্যথার ওষুধের মধ্যে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়। ব্যথার জায়গায় লাগিয়ে দিলে জায়গাটি ‘বে-বোধ’ হয়ে পড়ে। রোগী ভাবে ব্যথা সেরে গেছে। ব্যথানাশকের ‘অ্যাকশন’ শেষ হয়ে গেলে আবার ব্যথা, আবার ‘মারে, বাবারে’ শুরু হয়।

আমাদের দেশে ‘কর্তৃপক্ষ’ নামের একটি পক্ষ আছে। এই পক্ষের কাছেও মলম আছে। সেই মলমের নাম ‘আশ্বাস মলম’। এতে খুঁজলি–পাঁচড়া সারে না। শরীরের প্রতিটি জয়েন্টের, প্রতিটি পয়েন্টের ব্যথা–চাবানি সারায় না। তবে জনতার মনের ব্যথা ও ক্ষোভকে এই মলম ঠাস করে নামিয়ে ফেলে।

এই ‘আশ্বাস মলম’ অদ্ভুত ধরনের শেফা। ‘কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না’—হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্বের কায়দায় এই মলম পাবলিকের মনের ক্ষতস্থানে লাগাতে হয়। মলমটি লাগানোর নিয়ম হলো: ঠিক লোকের ঠিক জায়গায় ঠিক লোককে দিয়ে ঠিক পরিমাণে এটি লাগাতে হয়।

বাসচাপায় ছাত্রছাত্রী মারা যাওয়ার পর সহপাঠীরা রাগের চোটে রাস্তাঘাট আটকালে এই মলম লাগানো হয়। সহপাঠী হারানোর পর ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নামে। তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে। রাস্তার মধ্যে ‘অ্যানার্কি’ শুরু করে। সরকারের লোকজন জানে এটি বার্ড ফ্লুর চেয়ে বেশি ছোঁয়াচে রোগ। ফেসবুকের মধ্য দিয়ে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পোলাপানের মনে ক্ষতের ওপর ‘আশ্বাস মলম’ ডলে দেওয়া হয়। কয়েক দিন ব্যথাটেথা থাকে না। তারা চুপসে থাকে। কিছুদিন পর আবার হয়তো কোথাও কেউ বাসচাপা পড়ে, আবার ব্যথা চাগাড় দেয়। ‘সিচুয়েশন আউট অব কন্ট্রোল’–এ যাওয়ার আগেই আবার মলম লাগানো হয়। চাপা দেওয়া গাড়ির চালকের লাইসেন্স (যদি থাকে), ওই গাড়ির রুট পারমিট কটাস করে বাতিল করা হয়। তারপর বড় বড় লোকেরা ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই করে দেব সব’ বলেন। আসলে তাঁরা বলেন, ‘করে দেব শব’, আমরা শুনি ‘করে দেব সব।’ কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা যায় কাউকে না কাউকে ঠিকই ‘শব’ করে দেওয়া হয়েছে।

গত বছর জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ছাত্ররা ক্লাস থেকে রাস্তায় নেমেছিল। নেমেই তারা লাইসেন্স যাচাই করা শুরু করল। দেখা গেল ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। মান্যিগণ্যি লোকদের অনেকের লাইসেন্স কিংবা কমনসেন্স কোনোটাই পাওয়া গেল না। ছাত্রদের এই ননসেন্স কাজকর্ম বন্ধ করতে মলম লাগানো হলো। জাবালে নূরের রুট পারমিট বাতিল হলো। সরকার থেকে বলা হলো, ‘করে দেব সব’। ছেলেমেয়েরা ঘরে ফিরল। পরে দেখা গেল জাবালে নূর আবার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়ে উপায় নেই।

এই তো সেদিন মঙ্গলবার প্রভাতে সুপ্রভাত পরিবহনের অমাঙ্গলিক বাসটি বিইউপির ছাত্র আবরারের দেহকে যখন পিষে দিয়ে গেল, সেই মুহূর্তে হয়তো আমরা একে অন্যকে ‘শুভ সকাল’ কিংবা ‘গুড মর্নিং’ বলছিলাম। রক্তাক্ত আবরার হয়তো তখন ‘দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ’-এর মতো তড়পাচ্ছিল।

আবরারের সহপাঠীরা রাস্তায় নামতেই আন্দোলনের ওপর মলম দেওয়া হলো। সুপ্রভাত পরিবহনের বাস চালাতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। আবরারের পরিবারকে কিছু পয়সাকড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। আবরারের নামে পদচারী–সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর বসিয়ে ফেলা হলো। সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলল। ছেলেপেলে আশ্বস্ত হয়ে একটু নরম হতেই দেখা গেল পরের দিন খোলস পাল্টে ‘সুপ্রভাত’ হয়ে গেল ‘সম্রাট’ পরিবহন। সুপ্রভাত পরিবহনের ৭০টি বাস চলার কথা। কিন্তু প্রভাবশালী এক পরিবহন নেতার ক্যারিশমায় চলে দুই শয়ের বেশি। বোঝেন অবস্থা!

এর আগে বাসচাপায় পা হারিয়েছিলেন রাসেল সরকার নামের একজন প্রাইভেট কারচালক। দুই বাসের প্রতিযোগিতায় ডান হাত হারানো ছাত্র রাজীব তো মরেই গেলেন। গত শনিবার সিলেটে মো. ওয়াসিম নামের এক ছাত্রকে পরিবহনশ্রমিকেরা গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছেন। একই দিনে সড়কে নিহত হয় আরও চার শিক্ষার্থী। বোঝা যাচ্ছে, এই মৃত্যুর মিছিল থামবে না। এমন মরণ চলতে থাকবে। কর্তৃপক্ষের মলমের অ্যাকশন শেষ হলেই আবার ছেলেমেয়েরা ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে পথে নামবে।

কিন্তু কত দিন এই মলম ক্রমাগত উদগ্র হতে থাকা মনের ক্ষতের নিদারুণ প্রদাহকে চাপা দিয়ে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

সবাই জানে, সড়ক পরিবহনের ব্যবসাপাতি যাঁরা করেন, তাঁরাই সরকারের জায়গায় আছেন বা ছিলেন। তাঁরা একই সঙ্গে গোলকিপার, একই সঙ্গে স্ট্রাইকার। একই সঙ্গে মন্ত্রী ও লেবার লিডার। এই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট যত দিন থাকবে, তত দিন অনিয়ম দূর হবে না। জগৎ ও জীবনের তাবৎ বিষয়কে সংকীর্ণ এবং অসহিষ্ণু আত্মকেন্দ্রিকতার চশমা দিয়ে দেখা যতক্ষণ রাজত্বের ধর্ম বলে বিবেচিত হবে, ততক্ষণ এই অনিয়মের ঘা থাকবে। অ্যান্টিবায়োটিক না দিলে সে ক্ষত থেকে যাবে। মলমে কত দিন কাজ হবে, কে জানে!

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জে্যষ্ঠ সহসম্পাদক

sarfuddin2003@gmail.com