Thank you for trying Sticky AMP!!

পে-স্কেল অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক

>গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদিত হয়েছে। এতে গ্রেড ভেদে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বেড়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রকাশ করা হলো।
কার্টুন: তুলি

অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে, এটি খুবই ভালো কথা। আমি বলব, এটি সরকারের সময়োচিত ও যৌক্তিক পদক্ষেপ। সর্বশেষ পে-স্কেল দেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে, এরপর এবার দেওয়া হলো ২০১৫ সালে। এর মধ্যে সরকারের আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি কর্মচারীদেরও ব্যয় বেড়েছে। গত অর্থবছরের সরকারের বাজেট ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার, আর চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) সরকারের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। বেতন বৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে ১৫ হাজার ৯০৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তেলের দামও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমেছে, সরকার এখন জ্বালানি তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে। এর সঙ্গে সরকারের বাজেটের আকার যে হারে বেড়েছে, তাতে সরকারের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা কঠিন হবে না, তাকে আর্থিক ঘাটতিতে পড়তে হবে না।
এত ডামাডোলের মধ্যে পেনশনারদের পেনশন বৃদ্ধির বিষয়টি অনালোচিত থেকে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন পে-স্কেল এলে তাঁদের পেনশনও বাড়ে। আশা করি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে এ বিষয়টি চলে আসবে। এদিকে এই পে-স্কেলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড অবনমন করা হয়েছে। আমি মনে করি, সপ্তম পে-স্কেলে তাঁদের যে গ্রেড ছিল, সেটা এবারও বজায় রাখা উচিত।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলো ফেলতে চাই। পে-স্কেলের ৯ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীদের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা করা হয়েছে, আগে যেটা ছিল ১১ হাজার টাকা। এই স্তরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের এই গ্রেডেই সরকারি চাকরিতে রিক্রুট করা হয়। ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশন আলোচনার জন্য আমাদের মতো সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকেছিল। সেখানে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, মেধাবীদের আকর্ষণ করতে এই গ্রেডের মূল বেতন অনেকটা বাড়ানো উচিত। কারণ, এই মেধাবী তরুণ-তরুণীদের যে সহপাঠীরা ব্যাংকসহ অন্যান্য ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, তাঁরা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পান। আজকের বাজার অর্থনীতির যুগে সম্মানই বড় কথা নয়, এখন টাকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে জীবনের শুরুতেই এমন বৈষম্যের শিকার হলে হতাশা সৃষ্টি হয়।
অনেকেই বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে পে-স্কেল অনুমোদন করা ঠিক হয়নি। বাজারে যে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একেবারেই পড়বে না, তা নয়। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার রাশ টেনে ধরতে পারে। তবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়বে। প্রথমত, সরকারি কর্মচারীদের আয় বাড়লে তাঁরা আয়করও দেবেন বেশি, আবার তাঁদের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেশি থাকলে তা বাজারের জন্য ভালোই, যদি-না সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আর বেতন দ্বিগুণ বেড়েছে, কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন যে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন, পে-স্কেল বাস্তবায়ন হলে তা উঠে যাবে। আবার ইনক্রিমেন্ট সমন্বয় করা হবে। ফলে হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রকৃত অর্থে বেতন বাড়বে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আর ঢাকা শহরে কিন্তু বাড়িভাড়া কমতে শুরু করেছে। উত্তরা ও ধানমন্ডির মতো জায়গায় অনেক বাড়িই খালি পড়ে থাকছে। ফলে পে-স্কেলের ইতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়বে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লে দুর্নীতিও কিছুটা কমবে বলে আমার বিশ্বাস। অনেকেই আছেন, তাঁদের বেতন যতই বাড়ানো হোক না কেন, তাঁরা দুর্নীতি করবেনই। কিন্তু অনেকেই বাধ্য হয়ে দুর্নীতি করেন। বেতন বাড়ার ফলে এই শ্রেণির মানুষেরা দুর্নীতি করবেন না। আবার এর কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে, তাঁরা অনেক নির্ভার হয়ে কাজ করতে পারবেন। তাঁদের কাজের গুণগত মান ও ব্যাপ্তি দুটোই বাড়বে। অন্যদিকে বার্ষিক বেতন প্রবৃদ্ধির যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটাই অনেকটা স্থায়ী বেতনকাঠামোর কাজ করবে।
যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, সরকার তাঁদের ঝুঁকিভাতা দেয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরও প্রণোদনা হিসেবে ঝুঁকিভাতা দেওয়া যায়। কর্মকর্তারা সেসব অঞ্চলে সাধারণত যেতে চায় না। ফলে তাঁদের প্রণোদনা দেওয়া হলে তাঁরা সেখানে যেতে ও থাকতে উদ্বুদ্ধ হবেন। পয়লা বৈশাখ এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকার যে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে, এটার দরকার ছিল।
আরেকটি কথা বলা দরকার। সরকার এবার বাজেটে পেনশন ফান্ড গঠনের কথা বলেছে। এটি গঠিত হলে এর মাধ্যমেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এটি ভালো উদ্যোগ। এর পাশাপাশি, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও পেনশন তহবিল গঠন করা উচিত। যারা চাইবে, তারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এর সুবিধাভোগী হতে পারে। সরকার সেই টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে বিপুলসংখ্যক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতে পারে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।