
বর্তমান দুনিয়ার প্রায় সব জাতির ‘আধুনিক’ ইতিহাস লিখেছে পশ্চিমারা। তাই আধুনিক ইতিহাস লেখন ও পঠনপদ্ধতি উপনিবেশবাদ টিকিয়ে রাখার একটি মজবুত অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে বড় অবদান রেখেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস। সে কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন ইতিহাস সম্পর্কে শ্বেতাঙ্গদের দৃষ্টিভঙ্গি। মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন দখলদারির বৈধতা মিলেছে তাঁর লেখায়।
সেই বার্নার্ড লুইসের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী ইসরায়েলের নারী রাজনীতিক সিভি হটোভলি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে ব্রিটিশ ইহুদিদের আয়োজিত এক সভায় তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘নাকবা’ বা বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়নের ঘটনাবলির ইতিহাসকে ‘খুবই শক্তিশালী এবং খুবই জনপ্রিয় মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদের ঐতিহাসিক সত্যকে তিনি একটি কল্পিত কাহিনি বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য তিনিই প্রথম নন, তাঁর আগে অ্যারিয়েল শ্যারন, নেতানিয়াহুসহ বহু ইহুদিবাদী নেতা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের ইতিহাস অস্বীকার করেছেন।
আরবি শব্দ ‘নাকবা’র আক্ষরিক অর্থ দুর্যোগ, বিপর্যয়, আকস্মিক দুর্দশা। অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সময় থেকে বর্তমান ফিলিস্তিনে ইউরোপীয় ইহুদিদের আগমন শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তা বিপুলভাবে বেড়ে যায়। এই ইহুদিরা ফিলিস্তিনি ভূমির প্রায় ৮০ ভাগ দখল, প্রায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের স্থায়ী আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করে এবং এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস করে। তারা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং ধ্বংসযজ্ঞকে ফিলিস্তিনিরা নাকবা হিসেবে অভিহিত করে। ১৯৯৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র তার দখলদারির ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ফিলিস্তিন আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ইয়াসির আরাফাত ১৫ মে নাকবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৯৪৮ সালের বিপর্যয়ের পর ফিলিস্তিনিদের জীবনে আর কখনোই শান্তি আসেনি। বিপর্যয় অব্যাহত রয়েছে। ভূমিহারা ফিলিস্তিনিদের দুঃখ–কষ্টের কথা যে ইতিহাসবিদ এবং নৃবিজ্ঞানীরা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আহমাদ এইচ সা’আদি এবং লিলা আবু-লুগদ। নাকবাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় জীবনে যে দুর্দশা নেমে এসেছিল, তার একটি বর্ণনা রয়েছে তাঁদের যৌথভাবে সম্পাদিত নাকবা: প্যালেস্টাইন, ১৯৪৮ অ্যান্ড দ্য ক্লেইমস অব মেমোরি নামের গ্রন্থে। এ গ্রন্থে বাস্তুচ্যুত ও নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হারানোর স্মৃতিচারণা বিধৃত হয়েছে ওরাল হিস্টোরি বা কথ্য ইতিহাস সংকলনের মাধ্যমে। ফিলিস্তিনিদের কথ্য ইতিহাসসংবলিত আরও গ্রন্থ নাহলা আবদো ও নুর মাসালহার সম্পাদিত অ্যান ওরাল হিস্টোরি অব দ্য প্যালেস্টিনিয়ান নাকবা। এতে আছে লেবানন, ইরাকসহ নানান দেশের ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরগুলোতে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি হারানোর বেদনার স্মৃতি।
কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ওপর এই সীমাহীন অন্যায়-অবিচারের ইতিহাস ইসরায়েল রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকার করতে চায়। কিন্তু উল্টো দিকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপর নাৎসিদের নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞ চলেছে, যা ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত, তার ঐতিহাসিক সত্যাসত্য সম্পর্কে কেউ একটু প্রশ্ন তুললেই ইসরায়েল তো বটেই, আরও অনেক দেশ আইনগতভাবে ‘হলোকস্ট অস্বীকারের’ দায়ে শাস্তি দেয়। প্রকৃতপক্ষে নাৎসিদের হাতে ইহুদিদের হলোকস্ট আর জায়নবাদী ইহুদিদের হাতে ফিলিস্তিনিদের ‘নাকবা’ একই রকমের অন্যায় ও অপরাধ। তবে হলোকস্ট রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে জায়নিস্টরা কীভাবে ইসরায়েলের ক্রমাগত অত্যাচার এবং হত্যাকে বৈধতা দিয়েছে, তার একটি চিত্র উঠে এসেছে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নরম্যান ফিনকেলস্টাইনের দ্য হলোকস্ট ইন্ডাস্ট্রি গ্রন্থে। হলোকস্ট পরবর্তী সময়ে দুনিয়ায় অন্য সব নিপীড়িত জাতি ইসরায়েলকে নিজেদের পাশে চেয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল পাশে থাকেনি বরং ইতিহাস অস্বীকার করে ফিলিস্তিনিদের নাৎসি ক্যাম্পের কায়দায় বন্দী করে রেখেছে। গাজা, রামাল্লার জীবন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের নাৎসি ক্যাম্পগুলোর থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়।
হোয়েন ভিকটিমস বিকাম কিলার্স: কলোনিয়ালিজম, নেটিভিজম অ্যান্ড জেনোসাইড ইন রুয়ান্ডা নামের এক গ্রন্থে নৃবিজ্ঞানী মাহমুদ মামদানি জাতিগত ঘৃণা–বিদ্বেষ কীভাবে গণহত্যায় রূপ নিতে পারে, তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। যদিও গ্রন্থটি রুয়ান্ডার হুতি-তুতসি বিবাদের প্রেক্ষাপটে লিখিত, কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইউরোপে গণহত্যার শিকার ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে, তার মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সামগ্রিকতা বোঝার জন্য খুবই অর্থপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
সিপি হটোভেলি ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস অস্বীকারের চেষ্টা করলেন এমন এক সময়ে, যখন আরব রাষ্ট্রগুলো একে একে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে ওই আরব রাষ্ট্রগুলো পক্ষান্তরে হটোভলির বক্তব্যের বৈধতাই দিচ্ছে; ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের সব অন্যায়-অবিচার পক্ষান্তরে মেনে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক স্থাপন করার মধ্য দিয়ে কি তবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনিদের মুছে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে?
রাহুল আনজুম: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক