২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে উত্তাল ছিল সারা দেশ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের দাবিতে অটল—কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না তারা। আওয়ামী লীগও আদালতের রায় আর সংবিধানের দোহাই তুলে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। রাজধানীসহ দেশজুড়ে চলছে হরতাল। মন্ত্রীর বরাতে শোনা যাচ্ছিল দুই নেত্রীর কথা হবে। অনেকেই আশা করেছিলেন, সর্বোচ্চ দুই নেত্রীর আলাপের পর অচলাবস্থা কিছুটা হলেও কাটবে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখা গেল, তাঁদের সন্ধ্যাকালীন ৪০ মিনিটের ফোনালাপ সকাল না হতেই পৌঁছে গেছে সব কটি টিভি চ্যানেলে। এমনকি পত্রিকাতেও ছাপা হলো পুরোটা। এক দিনের মাথায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে অডিও ক্লিপটি।
অডিও ক্লিপটি কী করে সংবাদমাধ্যমের কাছে গেছে বা কারা রেকর্ড করেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী পরিষ্কার বলেন, দুই নেত্রীর ফোনালাপ দেশের মানুষের জানা অবশ্যই উচিত। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই অডিও ক্লিপ প্রকাশের দায় না নিয়ে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরলেন। এ ব্যাপারে না কোনো তদন্ত হয়েছে, না কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, না হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো রুল জারি করেছেন। ক্লিপটি নিয়ে যা হয়েছে, তা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল, টক শোতে ঝড়, কলাম লেখা ইত্যাদি। তাও এসবই হয়েছে দুই নেত্রীর কথোপকথনের বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে, ফাঁস নিয়ে নয়।
যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপ ফাঁস হয়, সেই দেশে আর কারও ফোনালাপ নিরাপদ, তেমনটি ভাবার কারণ নেই। যদিও আমাদের সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদ বলছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তির অন্য কারও সঙ্গে যেকোনো উপায়ে সব ধরনের যোগাযোগের গোপনীয়তা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত। এই যে কিছুদিন পরপর এর-তার এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকারের সমালোচকদের অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়, সেটি অসাংবিধানিক এবং ২০০১ সালের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এমনকি হাইকোর্ট থেকেও এ বিষয়ে একই ধরনের নির্দেশনা এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ে বিচারপতিরা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত চাহিদা ছাড়া ও গ্রাহককে অবহিত না করে সরকারি-বেসরকারি মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানি থেকে কললিস্ট বা কলরেকর্ড (কথোপকথন) সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। বিচারপতিরা সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অন্যান্য যোগাযোগের অধিকারের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটি কোনো আগ্রহী গোষ্ঠীর জন্য সহজেই লঙ্ঘন করা যাবে না।
একটি শব্দও ফাঁস না হওয়া সত্ত্বেও যেসব দেশের নাম পেগাসাস কেলেঙ্কারিতে এসেছে, তারা সবাই বিব্রত। বাংলাদেশের নাম এসেছে কি না, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের ফাঁসের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য, তাতে নিশ্চিত, এতে সরকার ন্যূনতমও বিব্রত হবে না। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় এ দেশের জনগণও এখন এর ভয়াবহতা ও বিপজ্জনক দিক আর অনুভব করে না।
সম্প্রতি পেগাসাস–কাণ্ড নিয়ে উত্তাল পুরো বিশ্ব। সারা পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার মানুষের ফোন থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এই নজরদারি প্রযুক্তির মাধ্যমে। এনএসও নামের একটি ইসরায়েলি বেসরকারি সংস্থা এই প্রযুক্তির জোগানদাতা। এ নজরদারি ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। এর আওতায় এসেছেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এমনকি রাজপরিবারের সদস্য, সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানেরাও বাদ যাননি। পেগাসাসে নাম আসা প্রতিটি রাষ্ট্রের নাগরিকেরা কেবল উদ্বেগেই পড়েননি, বরং সেসব রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানেরাও ভীষণভাবে বিব্রত হয়েছেন। এক দেশ আঙুল তুলছে অন্য দেশের দিকে। যদিও এনএসও বলছে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদ দমনে গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার রক্ষার ভালো ট্র্যাক রেকর্ডসম্পন্ন সরকারগুলোকে সাহায্য করা। আদতে দেখা যাচ্ছে সৌদি আরব, রুয়ান্ডা, টোগো, তুর্কমেনিস্তানের মতো চরম কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলোও এনএসওর কাছ থেকে এই নজরদারি প্রযুক্তি কিনতে পেরেছে।
পেগাসাস–কাণ্ডে ভারতের নাম খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে আসায় অনুমিতভাবেই ভারতের রাজনীতি উত্তাল হয়ে আছে। সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনের উদ্বোধনী দিন পুরোপুরি পণ্ড হয়েছে বিরোধী দলগুলোর তুমুল প্রতিবাদের মুখে। এখনো সংসদ প্রায় অচল। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে—এ রকম যৌক্তিক অভিযোগ আছে। কিন্তু এখনো সরকারের এমন আচরণের বিরুদ্ধে সংসদে, সংসদের বাইরে, সংবাদমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হতে পারে, হয়েছেও। অত্যন্ত কঠোর কথা বলছেন ভারতের বুদ্ধিজীবীরাও। যেটা এখনকার বাংলাদেশে কল্পনাও করা যায় না।
ভারতের ঘটনা দেখে বাংলাদেশের সঙ্গে আরেকটা খুব স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি। ভারতে সরকার রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক অধিকারকর্মী, শ্রমিকনেতা, বিচারপতিসহ নানা ক্ষেত্রের বহু মানুষের ফোনে আড়ি পেতেছে পেগাসাস সফটওয়্যার দিয়ে। অর্থাৎ সরকারের কাছে অসংখ্য অডিও রেকর্ড আছে, যেগুলো ফাঁস করে দিলে সরকারের টার্গেটেড লোকজন বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি, এমন একটা কলরেকর্ডও ফাঁস হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে হরহামেশাই নানা অডিও কলরেকর্ড বেরিয়ে আসে। এসব রেকর্ডে প্রায় সময়ই থাকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা সরকারের সমালোচনাকারী কোনো ব্যক্তির কথোপকথন। এসব কথোপকথনের ভিত্তিতে মানুষকে নানা মেয়াদে জেলে অন্তরীণ রাখার উদাহরণও আছে। কিন্তু পেগাসাসের সাহায্য নেওয়া চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো পর্যন্ত তাদের আড়ি পেতে শোনা কথোপকথন প্রকাশ করেনি।
মজার ব্যাপার, বাংলাদেশে যখনই কোনো অডিও ক্লিপ (বিরোধী দল বা সরকার সমালোচক ব্যক্তির) প্রকাশিত হয়, তখন সেটা দফায় দফায় প্রচারিত হয় মূলধারার বেশ কিছু টিভি চ্যানেলে। সেই কথোপকথনের বিস্তারিত প্রকাশিত হয় মূলধারার কিছু সংবাদপত্র ও পোর্টালেও। অথচ এই চরম অসাংবিধানিক এবং বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের তরফে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টের যেহেতু সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, তাই এ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নেওয়া হলে জনগণ আশ্বস্ত হতে পারত।
একটি শব্দও ফাঁস না হওয়া সত্ত্বেও যেসব দেশের নাম এ কেলেঙ্কারিতে এসেছে, তারা সবাই বিব্রত। বাংলাদেশের নাম এসেছে কি না, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের ফাঁসের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য, তাতে নিশ্চিত, এতে সরকার ন্যূনতমও বিব্রত হবে না। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় এ দেশের জনগণও এখন এর ভয়াবহতা ও বিপজ্জনক দিক আর অনুভব করে না। আমাদের দেশে বৃহৎ পরিসরে ফাঁসের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা দুই নেত্রীর টেলিকথোপকথন ফাঁসের মধ্য দিয়ে, যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাকুক, নানাভাবে এ ফাঁসকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় এখনো। তাই পেগাসাস এখানে নতুন করে আর ভাবায় না কাউকে। আমরা পেগাসাসকে ছাড়িয়ে গেছি বহুদিন আগেই। এ মাটিতে পেগাসাস নস্যি।
● রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী