বাজেটকে কার্যকর করব কীভাবে?

চলতি বছর সম্ভব না হলেও গত কয়েক বছরের প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় আমরা রাজস্ব ভিত্তি বাড়ানো, সামাজিক খাতে অধিক বরাদ্দ, প্রবৃদ্ধি চাঙা করে এমন প্রকল্প নির্বাচন ও যথাসময়ে তা বাস্তবায়ন, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, বিতর্কের ঊর্ধ্বে ক্রয়প্রক্রিয়া, বাজেটারি বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোসহ প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলে আসছি। সেই সঙ্গে কিছু কিছু আলাপচারিতা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য জাতীয় অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন, জেলা বাজেট সম্প্রসারণ, গ্রামাঞ্চলে হেলথ কার্ড প্রবর্তন, শস্যবিমা প্রবর্তন এবং জাতীয় পেনশন ফান্ড চালুর বিষয়েও। বিপরীতে, অন্য দেশ কী করছে বা প্রত্যাশিত সুফল অর্জনে কার্যকর বাজেট বরাদ্দ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া নিশ্চিতে কী করা যায়, তাতে খুব কমই মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। কোভিডসহ বিভিন্ন কারণে এবার কোনো প্রত্যক্ষ আলোচনা না হলেও বিভিন্নভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এযাবৎ কম আলোচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। এ আলোচনা সংগত কারণেই সাবেক অর্থসচিববৃন্দ এবং বাজেট বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিবদের সঙ্গেও বিস্তৃত ছিল।

মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) তৈরিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাক্কলনের কার্যকর ব্যবহার: ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এমটিবিএফ শুরু করেছে, যা এখন সব মন্ত্রণালয়েই চালু রয়েছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দিক থেকে এর প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা এখনো উৎসাহব্যঞ্জক নয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘ডিপেনিং এমটিবিএফ’ (২০০৯-১৪) প্রকল্পও খুব একটা সন্তোষজনক মূল্যায়ন পায়নি। ২০১৫ সালে চারটি মন্ত্রণালয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে সংস্থাটি সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যে প্রকল্পের মেয়াদ অল্প সময়েই শেষ হবে। এ ক্ষেত্রে এমটিবিএফের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আবার একটি আলোচনা সভারও আয়োজন করতে পারে। সেখানে হিসাব প্রাক্কলনের প্রস্তুতি, নৈপুণ্য বৃদ্ধি, বাজেটের সুফল বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বা বিশ্লেষণী সহযোগিতার মতো আরও কারিগরি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার আছে কি না, তা জানা যেতে পারে।

নির্বাচিত কর্মসূচির কার্যকারিতা মূল্যায়ন সমীক্ষা পরিচালনা: এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় (ক) সুনির্দিষ্ট প্রকল্প/কর্মসূচি শুরুর আগে ভিত্তিরেখা ও অনুমান প্রতিষ্ঠায় প্রাক্‌-প্রকল্প মূল্যায়ন সমীক্ষা, (খ) চলমান প্রকল্প বা কর্মসূচির মধ্যবর্তী সংশোধনে অব্যাহত পর্যালোচন, এবং (গ) আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন মূল্যায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী সমীক্ষা পরিচালনা করতে পারে।

ডায়াগনস্টিক বা নির্ণয়মূলক মূল্যায়ন উদ্যোগ গ্রহণ: অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের নির্বাচিত প্রধান প্রকল্প/কর্মসূচির তহবিল প্রবাহের জীবনচক্র চিহ্নিত করতে সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা (পিইআর) বা সরকারি ব্যয় ট্র্যাকিং জরিপ (পিইটিএস) গ্রহণ করতে পারে এবং যথাযথ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জোর দিতে পারে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুলের বিকেন্দ্রীকরণ/উপজেলা পর্যায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক পিইটিএস সম্পন্ন করেছিল। এ মূল্যায়ন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বব্যাংক উভয়ের কাছেই সমাদৃত হয়েছিল।

কন্ট্রাক্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিএমএস) বা চুক্তি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন: ক্রয়ে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হওয়ায় এ ক্ষেত্রে একটি কাঠামোবদ্ধ চুক্তি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের কথা অনেকেই বলেছেন, যা ক্রয়ের পুরো চক্র, ক্রয় পরিকল্পনার শুরু থেকে বাজেটিং, টেন্ডারপূর্ব কাজ, ক্লিয়ারেন্স/অ্যাকুইজিশন/প্রাক্‌-নির্মাণ জরিপ ও তদন্ত, চুক্তি ও টেন্ডারপূর্ব কাজসহ পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া তদারকি, বিরোধ নিষ্পত্তি প্রভৃতি বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

কমিটমেন্ট কন্ট্রোল সিস্টেম (সিসিএস) বা অঙ্গীকার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন: হিসাবের নগদভিত্তিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় আনুষ্ঠানিক সরকারি হিসাব/রাজস্ব প্রতিবেদনে অঙ্গীকারগুলো ও স্টক বা ব্যয়প্রবাহ চিহ্নিত করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে প্রকৃতপক্ষে কত দেওয়া হয়েছে, তা প্রায় অজানা থেকে যায়। কাজেই এ ক্ষেত্রে অঙ্গীকারের পুরো জীবনচক্র ধরা এবং বিদ্যমান বহু বছর পরিপ্রেক্ষিত থেকে নেওয়া কর্মসূচিগুলোয় তার প্রভাব মূল্যায়নে অঙ্গীকার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যেতে পারে।

সমন্বিত বাজেট ও হিসাবব্যবস্থা (আইবাস‍+‍+) পর্যালোচনা, শক্তিশালী করা ও সম্প্রসারণ: সংশ্লিষ্ট আলোচনাগুলোতে এই ব্যবস্থার কিছু প্রাথমিক উদ্যোক্তাসহ অনেকেই আইবাস‍+‍+এর বিদ্যমান কার্যকারিতা পর্যালোচনার প্রস্তাব করেছেন এবং আলোচ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা জোরালো করতে সহযোগিতার কথা বলেছেন। এ বিষয়টিতে ইতিমধ্যেই বেশ নজর দেওয়া হয়েছে। এই কাজ সম্পন্ন হলে সামগ্রিক বাজেট ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে। সেই সঙ্গে এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বাজেটারি বরাদ্দের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণের কাজটি সম্পৃক্ত করা গেলে অনেক ভালো হবে। আমাকে অর্থ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তাই বলেছেন, কার্যকর বাজেট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে আইবাস‍+‍+ প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণ বা সামান্য আধুনিকায়নই যথেষ্ট।

প্রকল্প মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি ও বাস্তবায়ন: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে, যাতে বিনিয়োগকৃত প্রকল্পের মূল্যায়ন ও তদারকি জোরদার করা যায়। এ ক্ষেত্রে আলোচ্য প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করার সক্ষমতা জোরদার ও গুণগত মান মূল্যায়নের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

পিপিপি প্রজেক্টে কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি (সিএল) ব্যবস্থাপনায় পৃষ্ঠপোষকতা জোগানো: কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি (সিএল) বা সহযোগী দায় ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি, প্রকল্প অনুমোদন/প্রক্রিয়া ও প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে সিএল-সম্পর্কিত সংযোগ সম্প্রসারণ, পিপিপি-সংক্রান্ত রাজস্ব নীতির অপশন তৈরি, ঋণ স্থায়িত্বের বিশ্লেষণে সিএল মেইনস্ট্রেইমিং করাসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের কার্যকর বাস্তবায়নের দিকে সত্যিকারভাবে অগ্রসর হতে পারে।

আন্তসরকারি রাজস্ব সম্পর্ক কাঠামো পর্যালোচনা: অর্থ মন্ত্রণালয় লক্ষ্য, ব্যাপকতা, কার্যকারিতা ও বিদ্যমান লেনদেন ব্যবস্থায় সমতাসহ প্রধান প্রধান বিষয় যাচাই করতে একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া উন্নয়ন করতে পারে।

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কাঠামো শক্তিশালীকরণ: ঝুঁকিভিত্তিক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ম্যানুয়েল তৈরিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টা বাড়ানো দরকার এবং লেনদেনমূলক নিরীক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যাচাইয়ে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট শাখা শক্তিশালী করা জরুরি।

কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা: অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নীতি ও প্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এমটিবিএফ বা মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোসহ প্রত্যাশিত বিভিন্ন বিষয়বস্তুর ওপর প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা জরুরি; বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তাদের। এ বিষয়ে কিছু কাজ হলেও জোরের সঙ্গে এখনো নামা হয়নি।

বাংলাদেশের বাজেটের আকার বাড়ছে। ফলে আলোচ্য বাজেট সামলানো ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই আমাদের অবশ্যই বাজেট বরাদ্দে দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে ভালো ফল আসতে অনেকটা বাধ্য। সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো এতে অপচয় হ্রাস পাবে, ব্যয় ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আসবে এবং এর প্রকৃত সুফল পাবে সাধারণ জনগণ।

বাজেটের দুটি প্রধান বিষয় হলো সম্পদ আহরণ ও সম্পদের বণ্টন। বণ্টনের ক্ষেত্রে আবার বরাদ্দ (জাতীয় প্রাধিকার বিবেচনায়) অনুযায়ী খরচ, যে উদ্দেশ্যে খরচ, তা থেকে আকাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছি কি না, সেটা নিশ্চিত করাও কার্যকর বাজেট ব্যবস্থাপনার একটি বিরাট বিষয়।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক।