
দলের মতো দল একাই এক শ, যদি থাকে তার শক্ত নীতি-আদর্শ, ব্যাপক জনসমর্থন এবং যদি থাকেন নেতার মতো নেতা। ছোট–মাঝারি দেশে দু-চারটির বেশি বড় দলের প্রয়োজন হয় না। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে কয়েক শ দল থাকা অস্বাভাবিক নয়।
দলের মতো দল হলে তার বেশি সহযোগীর প্রয়োজন হয় না, বেশি ভাই-বেরাদরেরও দরকার নেই। দলেরই যদি শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থন না থাকে, তাহলে শ খানেক সহযোগী সংগঠনও কাজে আসে না, অসংখ্য অঙ্গসংগঠন দিয়েও দুপয়সার উপকার হয় না, ডজন ডজন ভ্রাতৃপ্রতিমকে দিয়েও লাভ হয় না।
রাজনৈতিক দল পরিবারের মতো। একেবারে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত যাঁরা দলের নির্বাহী কর্মকর্তা, তাঁরাই দলের ভাইবোন। এর বাইরে আবার নানান রকম ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বা উপদলের প্রয়োজন হয় কেন? সংগঠন মানেই নেতা, নেতা মানেই তাঁর একটা পদ। বাংলার মাটি আজ বিচিত্র সংগঠনের পদধারীতে সয়লাব হয়ে গেছে; তাঁদের দৌরাত্ম্য মঙ্গোলীয় পদাতিক বাহিনীর চেয়ে কম নয়।
বাঙালি যখন যা করে, ঘটা করে করে, শান্তভাবে ধীরস্থিরভাবে কোনো কিছু করা তার স্বভাব নয়। যেকোনো সমস্যা সমাধানে বাঙালি নেমে পড়ে মালকোঁচা মেরে, কিন্তু শেষটা সুচারুভাবে করতে পারে না। প্রায় সব ক্ষেত্রে মাঝপথে রণে ভঙ্গ দেয়। শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, দেখাও যাচ্ছে। অভিযানটি আরম্ভ হওয়ার পর ভ্রাতৃপ্রতিম যুবসংগঠনের শীর্ষ নেতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধমক দিয়ে বললেন, তাঁরা নাকি এত দিন বসে বসে ‘আঙুল চুষেছেন’। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর ধমকে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে, কিন্তু যখন দেখলেন তারপরও অভিযান অব্যাহত রয়েছে, তখন গলার সুর পাল্টালেন। উপমা দিয়ে তিনি বললেন, এই অভিযান বাজ পড়ার মতো এবং তাঁর ভাষায় ‘বাজটা পড়েছে ঠিক আমার মাথায়’। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রাঘাতে লোক মারা যায়। কোনো ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মাথায় বাজ পড়া বা বজ্রপাত এই প্রথম।
শুদ্ধি অভিযানকে আখ্যায়িত করা হয়েছে বজ্রাঘাতের সঙ্গে। মধ্যযুগে ধর্মচ্যুত পাপী-তাপী ও অস্পৃশ্য ব্যক্তিদের একধরনের শাস্তি দিয়ে শুদ্ধ করে ধর্মের পথে আনা হতো। কোনো কোনো সমাজে পাপী ও ধর্মচ্যুত ব্যক্তিকে একটু গোবর ও কিছুটা গোচোনা খাইয়ে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা হতো। ওগুলো ছিল প্রথাগত শুদ্ধি অভিযান। আধুনিক রাষ্ট্রের শুদ্ধি অভিযান গোবর ও গোচোনা খাইয়ে সম্পন্ন হয় না। হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি ও মাথায় হেলমেট। ৪০ হাজার টাকা দামের নকশি করা পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা কোটির পরিবর্তে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। সাদ্দাতের বালাখানা থেকে বেশি সুসজ্জিত ভবন থেকে শ্রীঘরে।
সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের এমন মহিমা যে আরব্য রজনীর জাদুর চেরাগ যা না পেরেছে সংগঠনের নেতৃত্ব তার চেয়ে বহুগুণ দিয়েছে। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের প্রাসাদে গিয়ে তাঁর জীবনযাপনের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি, রাশিয়ার জারদের জীবনযাপনও দেখিনি, একালে জাপানের সম্রাটের প্রাসাদে প্রবেশ করিনি, তবে বহু বছর আগে ইরানের শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলভির প্রাসাদ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। শাহ ও রানি ফারাহ দিবার শয়নকক্ষও দেখেছি। শাহের প্রাসাদের আসবাব, খাট-পালঙ্ক, বালিশ, বেডশিট, বেডকভার প্রভৃতি আমাদের সম্রাটদের ঘরবাড়ির সাজসজ্জার কাছে কিছুই নয়। আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের রাজন্যবর্গের বাড়িতে ও অফিসে বিপুল বিদেশি মদের সমাহার। অত মদ অনেক শুঁড়িখানায়ও থাকে না। যেখানে মদ আছে, সেখানে ইয়ে না থেকেই পারে না। অবশ্য অভিযানের সময় মদের বোতল আটক হলেও তাদের কাউকে দেখা যায়নি।
ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতার অন্যতম পত্নী বলেছেন, ‘দোকান, গাড়ি, ফ্ল্যাট—এগুলো তাঁর নেশা নয়। ওর সম্পদ বলতে কিছুই নাই। ক্যাসিনো চালিয়ে ও যে আয় করে, তা দলের জন্য খরচ করে, দল পালে। আর যা থাকে, তা দিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে জুয়া খেলে।’
আধ্যাত্মিকভাবে দেখলে মানবজীবনটাই একটা জুয়া খেলা। জীবনের জুয়ায় কেউ কেউ জেতে, হেরেই যায় অধিকাংশ। রাজনীতির জুয়া খেলায় যে জেতে, তার হাসির শেষ নেই। যারা হারে, তাদের মাথা চাপড়ে হাহাকার করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তাঁর সহধর্মিণীর কথায় এটা মনে হবে, তাঁর মতো নিবেদিত ও নিঃস্বার্থ নেতারই একটি জনপ্রিয় সংগঠনে প্রয়োজন।
সরকারি দলের বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের একেকটি অফিস যেন পীর-ফকিরের খানকা শরিফ। সেখানে ভক্তিবাদিতার পরাকাষ্ঠা। নেতারা যেন একেকজন পীর। যে পাড়ায় একজন নেতা থাকেন, সেখানকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ। যখন তাঁরা রাস্তায় বের হন দামি গাড়িতে, তাঁদের আগে-পিছে প্রটোকল দেন ডজনখানেক মোটরসাইকেল আরোহী। তাঁদের জীবনযাপন মধ্যযুগের সামন্ত প্রভুদের মতো। নেতা যদি রাস্তায় কিছুটা হাঁটেন, তাঁর সঙ্গে থাকেন জনা পঞ্চাশেক কর্মী। যদি কোনো জনপদে তশরিফ আনেন, তাঁদের শুভ আগমনে হৃৎকম্প শুরু হয় দোকানি-ব্যবসায়ীসহ শুধু সাধারণ মানুষের নয়, সরকারি কর্মকর্তাদের পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগের গৌরবের কাল ছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১। সেই ২২ বছর পাকিস্তানে দুটি ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচন দুটিতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছে বিরোধী দল থেকে এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয় অর্জন করেছে। সেই ২২ বছর দলের কোনো অঙ্গসংগঠন বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছিল না। একমাত্র বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ছিল এবং দলের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামে ও গণতন্ত্রের আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্রলীগ নেতাদের বাড়ি-গাড়ি, ধনদৌলত ছিল না, ছিল তাঁদের বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও সংগ্রামী চেতনা।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, শেষ পর্যায়ে হয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ; কোনো অঙ্গসংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রয়োজন হয়নি। স্বাধীনতার পরে দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই একের পর এক অঙ্গসংগঠনের উদ্ভব। ‘জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২’ বহুবার সংশোধিত হয়েছে। শেষবার হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে। সব দলের সঙ্গে কথা বলেই সংশোধন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-এ তা সংসদে অনুমোদন দেয়। তাতে অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠনের কোনো বিধান নেই। তা না থাকলেও আমাদের দলগুলোর নেতারা বসে থাকতে পারেন না। তাঁরা এখন নাম দিয়েছেন ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’। যাহোক, নামে কিছু আসে যায় না, উদ্দেশ্যই আসল। এখন আট-নয়টি ভাইয়ের মতো সংগঠন রয়েছে, যেমন জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ কৃষক লীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী মহিলা লীগ প্রভৃতি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগে ১৮টি বিভিন্ন বিষয়ক সম্পাদক রয়েছেন, যেমন কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, আইন, তথ্য ও গবেষণা, প্রচার, যুব ও ক্রীড়া, পরিবেশ, আন্তর্জাতিক, ধর্ম, শ্রম, মহিলা প্রভৃতি। এরপর নানা রকম ‘ভ্রাতৃপ্রতিমে’র প্রয়োজন কী? তাঁদের নেতাদের কাজটা কী?
এই আট-নয়টি ‘ভ্রাতৃপ্রতিমে’র বাইরে গত ১০-১২ বছরে সারা দেশে জন্ম নিয়েছে অজস্র ‘লীগ’। বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নামে গড়ে উঠেছে অগণিত ‘লীগ’। গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার—কোথায় ‘লীগে’র সাইনবোর্ড নেই? সেগুলোর নামে ডিজিটাল ব্যানার শোভা পাচ্ছে বিদ্যুতের খাম্বায়, সড়কদ্বীপে, গাছের ডালে। ওই সব লীগের নেতারা সারা বছরই ‘শোকাভিভূত’, কখনো দিচ্ছেন ‘প্রাণঢালা শুভেচ্ছা’। হাজারো লীগের নেতারা ছাপিয়ে নিয়েছেন বহুরঙা বিজনেস কার্ড দামি পেপারবোর্ডে। কজন ভ্রাতৃপ্রতিমের বিরুদ্ধে সরকার শুদ্ধি অভিযান করবে?
ভ্রাতৃপ্রতিমদের রাখার প্রয়োজন আছে কি না, তা শীর্ষ নেতাদের ভাবতে হবে। তা ছাড়া, মানুষ শক্ত শুদ্ধি অভিযানই দেখতে চায়। বর্তমান শুদ্ধি অভিযান যেন গোদা পায়ের লাথি না হয়। গোদা পায়ের লাথি বাইরে থেকে দেখে মনে হয় ভয়ংকর, প্রকৃতপক্ষে গোদা পায়ের লাথিতে জোর কম। সঠিক জায়গায় শক্ত আঘাত হানা চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক