অভিবাসন

মানুষের উন্নতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন

ভূমধ্যসাগরে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ
ভূমধ্যসাগরে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ

এখন ঈদের ছুটির সময়ও দেখা যায়, ঢাকার রাস্তা সুনসান হয়ে যায় না। অসংখ্য মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও মহানগরের রাস্তাঘাটে অনেক মানুষ চলাচল করেন। কিন্তু বছর দশেক আগেও ঈদের ছুটির কয়েকটা দিন ঢাকার রাস্তাঘাট বেশ নির্জন-নিরিবিলি থাকত। কিছু সড়কে তো কিশোর-তরুণদের ক্রিকেট খেলতেও দেখা যেত।
অর্থাৎ রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ইতিমধ্যে অনেক বেড়েছে এবং অনেক মানুষের দেশগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়েছে। তা ছাড়া মানুষের চলাচলও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরে চলে আসছে, অধিকাংশেরই গন্তব্য রাজধানী ঢাকা। তবে জেলা শহরগুলোতেও গ্রাম থেকে আসা মানুষের ভিড় বেড়েছে এবং আরও বাড়ছে। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বেড়ে যাওয়ার এটিই প্রধান কারণ। ইজিবাইকের চালকদের অনেকেরই পারিবারিক অবস্থা ভালো। কিন্তু নিয়মিত উপার্জনের আশায় তাঁরা ইজিবাইক চালাচ্ছেন। বলা যায়, এই সময়ের মূল প্রবণতা হলো, সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে নিজের উন্নতি ঘটাতে চাচ্ছেন। সে কারণেই এত চলাচল, এত সড়ক দুর্ঘটনা।
দেশে চরম দারিদ্র্যের শিকার মানুষের সংখ্যা কমেছে, এখন এর পরবর্তী ধাপে যাওয়ার পালা। মূলত এই প্রবণতা থেকেই মানুষের দেশান্তরি হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আগেও দেখা গেছে, অনেকের পারিবারিক অবস্থা আপেক্ষিকভাবে ভালো হওয়া সত্ত্বেও অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আপাতভাবে এই চেষ্টায় দোষের কিছু নেই। এটা ইতিবাচক, কারণ অভিবাসী মানুষের মধ্যে উদ্যম-উদ্যোগ বেশি দেখা যায়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্র মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারছে না। সে কারণেই আমাদের বড় শহরগুলোর অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হয়ে চলেছে। গ্রামে কাজ নেই, সেখানকার মানুষের নিয়মিত উপার্জন নেই, সে কারণে সবাই শহরে আসতে চায়।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার পর এবার খবর পাওয়া গেল বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে আটকা পড়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁদের ফেরত নেওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিসংখ্যান অনুসারে ডিঙিনৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ ভাগ্যোন্নয়নের তাগিদ বাংলাদেশিদেরই বেশি!
যা হোক, আমাদের দেশের মানুষ ইরাক-সিরিয়ার মানুষের মতো যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য দেশ ছাড়ছেন না। এঁদের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমাদের দেশের মূল সমস্যা কর্মসংস্থান। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিপুল। অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, আমাদের যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিস্থিতি নেই। এর সঙ্গে খবর আসছে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়েছে। আবার প্রবাসীরা দেশে যে টাকা পাঠাচ্ছেন, সেটাও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। সেই টাকা দোকানপাট, ঘরবাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হচ্ছে; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এমন কোনো খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
আমরা নগরবাসী ব্যাপারটা কতটা বুঝতে পারছি জানি না, কিন্তু সমাজে একধরনের আলোড়ন চলছে। সবাই নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে সরকার যদি গ্রামাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলায় মনোযোগ দেয়, তাহলে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্যম কাজে লাগানো যেত। তখন যেমন এই মানুষদের শহরে এসে বস্তিতে থাকতে হতো না, তেমনি বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে হতো না। অর্থাৎ সরকারের মুদ্রানীতিতে এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে করে এই মানুষদের পক্ষে সামষ্টিক অর্থনীতির আর্থিক ব্যবস্থায় ঢোকার সুযোগ হয়। শহর থেকে নানাভাবে গ্রামে টাকা যাচ্ছে। সেই টাকাও মূলত জমি ও ঘরবাড়ি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের যেমন সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেওয়া উচিত, তেমনি বিনিয়োগেরও সুযোগ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে, রেমিট্যান্স বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হলে ব্যাপারটা আদর্শ হতো। সেটা হলে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। বলা যায়, তারা নিজেরাই সে জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে শহুরে শিক্ষিত তরুণদের প্রধান সমস্যা হলো কর্মসংস্থান। অনেক শিক্ষিত তরুণ চাকরি না পেয়ে নিজের মতো করে নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আমরা এমন খবরও জানি, মাস্টার্স পাস করা তরুণদের কেউ কেউ সকালবেলা পার্কে কিংবা ঝিলের পাড়ে ওজন ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্র নিয়ে বসছেন। প্রাতর্ভ্রমণকারীদের রক্তচাপ ও ওজন মেপে তাঁরা জীবিকা অর্জন করছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠান তো এক দিনে গড়ে ওঠে না, সময় লাগে। এই তরুণদের উদ্যোক্তা বানানো গেলে, তাঁরা নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারবেন। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সহজ নয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা না গেলে এটা নিশ্চিত করা সহজ হবে না।
একই সঙ্গে, পড়াশোনা করে শুধু চাকরিই করতে হবে—এই মানসিকতাও বর্জন করতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে জাতি হিসেবে আমাদের বিশেষ অগ্রগতি ঘটবে না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন?’ শিরোনামের প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা যায়: ‘আমরা দশ-পনেরো টাকার বিনিময়ে মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা অনায়াসে প্রভুর পায়ে বিকাইয়া দিব, তবু ব্যবসা-বাণিজ্যে হাত দিব না, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াইতে চেষ্টা করিব না। এই জঘন্য দাসত্বই আমাদিগকে এমন ছোটো হীন করিয়া তুলিতেছে। ...যে জাতির মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প যত বেশি, সে জাতির মধ্যে স্বাধীন-চিত্ত লোকের সংখ্যা তত বেশি। আর কাজেও যে জাতির জনসংঘের অধিকাংশেরই চিত্ত স্বাধীন, সে জাতি বড় না হইয়া পারে না। ব্যষ্টি লইয়াই সমষ্টি।’
অভিবাসনের প্রসঙ্গে বলা দরকার, বিশ্বায়নের যুগে পুঁজির মতো মানুষের চলাচলও অবাধ হওয়ার কথা। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে উন্নত দেশগুলোর পক্ষে সব সময় অভিবাসী গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এর বিকল্প হিসেবে তারা আমাদের মতো দেশগুলোয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না করে বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে পারে, যদিও সেটা গ্রহণে আমাদের সক্ষমতা থাকা দরকার। এর জন্য দরকার সুশাসন। সেটা নিশ্চিত করা গেলে এই মানুষদের আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগানো সম্ভব হতে পারে।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।