শহীদ বুদ্ধিজীবী, জুট মিল কর্মী,অভিনয় শিল্পী, দিনাজপুর, রংপুর
ছোটবেলা থেকেই ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মিজানুর রহমান মিজুর বিচরণ ছিল অবাধ। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস খেলায় ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
বিতর্ক, আবৃত্তি ও কমিক প্রদর্শনেও তাঁর পরিচিতি ছিল ব্যাপক। ছাত্র আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন নাট্যাঙ্গনে—টেলিভিশন, বেতার ও মঞ্চে।
শিল্পী মিজানুর রহমানের জীবনাবসান হয় মর্মান্তিকভাবে। তিনি চাকরি করতেন ঢাকার অদূরে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ন্যাশনাল জুট মিলে আক্রমণ চালায়। তাঁকেসহ ৯৬ জনকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে।
পরে তাঁদের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে হত্যা করার জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু টেলিভিশনে নাটক করার সুবাদে পাকিস্তানি সেনা দলের এক ক্যাপ্টেন তাঁকে চিনতে পেরে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু পরে আরেক দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা ৯৬ জনের কাউকেই ছাড়েনি। প্রত্যেককে গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় মিজানুর রহমানের ভ্রাতুষ্পুত্রী জিনিয়া রহমানের ‘আমার কাকু’ রচনা থেকে। তিনি ঘটনার আংশিক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
জিনিয়া রহমান লিখেছেন, ‘মিজু কাকুর কথা মনে পড়লে ’৭১-এর কিছু ঘটনার ছবি আমি দেখি।
‘তারিখটা ছিল ১ ডিসেম্বর।
হানাদার বাহিনীর একটা দল ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিল এরিয়াতে তাদের হিংসাত্মক আক্রমণ শুরু করেছে। আকাশে-বাতাসে আর্তনাদ, পালাও পালাও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
যে যেখানে সম্ভব তৎক্ষণাৎ পালিয়েছে। ছোট কাকু আমাকে নিয়ে অল্প দূরের এক গোয়ালঘরের খড়ের গাদায় আশ্রয় নিয়েছেন।
কিন্তু সেই ছোট আমি তখনকার ভয়াবহতাকে বুঝতে না পেরে মায়ের কাছে যাবার জন্য কান্না জুড়ে জেদ করাতে ছোট কাকু আল্লাহর নাম করে আমাকে সেখান থেকে বের করে দিতে বাধ্য হন।
আমি তখন গোলাগুলির শব্দে ভয় পেয়ে মায়ের কাছে যাব বলে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে চলেছি। আমার এই মিজু কাকুই সেদিন এত গোলাগুলির মধ্যে দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
‘সেদিন পরাজয়ের মুখে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই হানাদাররা সবাইকে বের করে নিয়ে এল।
কিন্তু কি আশ্চর্য, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তাঁদের লাইনে দাঁড় করানোর পরও ক্যাপ্টেন সবাইকে ছেড়ে দিল।
কাকুও ছিলেন সেই দলে। কেন?
তিনি টেলিভিশনের পরিচিত শিল্পী, অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। ক্যাপ্টেন তাঁর আবেদনটি রাখল—ঠিক হ্যায় তুম যাও।
কিন্তু না। তখনই এল আরেক দল হায়েনা। তাদের কাছে গুণীর কদর নেই। শিল্পীর দাম নেই—বুলেটে বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
সবুজ ঘাসের বিছানায় বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে আমার মিজু কাকু মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
...প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই সব মৃত, অর্ধমৃত ও আহতদের ছেড়ে সেদিন আমরা জীবিতরা আর সবার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
আশ্রয় নিয়েছিলাম যে যেখানে পারি। দুই দিন পর আকাশে দেখা গেল বোমারু বিমান। বেতারে জানা গেল মিত্রশক্তি ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা।
এরপর অনেকেই তথ্য নিয়ে এল ওই এলাকা থেকে পাকসেনারা পালিয়ে গেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই সকলে ছুটল নিহত-আহত আপনজনদের কাছে।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের খোলা মাঠে শিয়াল-কুকুর-শকুনের খুবলে খাওয়া দেহগুলো প্রত্যেকে নিয়ে এসে যে যার মতো কবর দিল।
মিজু কাকু ও আব্বুর আপন ফুফাতো ভাই শহীদুল্লাহ ও সলীল কাকু, মোজাম্মেল ফুফা (প্রকৌশলী) এবং এমনি অনেক আত্মীয়-অনাত্মীয় পরিচিতদের দাফন করা হলো ওই অঞ্চলের পরিচিত এক সম্পন্ন কৃষকের পারিবারিক গোরস্থানে।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
মিজানুর রহমানের জন্ম ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়ায়। আইনজীবী বজলুর রহমানের পাঁচ ছেলে ও মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
মা জোবেদা খাতুন। তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি স্থানীয় মিশন স্কুলে। দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন।
তখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অবাঙালি। কলেজের এক অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ উর্দুতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে মিজানুর রহমান এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
অধ্যক্ষ বাধ্য হন ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে। দিনাজপুরে থাকাকালে স্থানীয় নবরূপী ও নাট্য সমিতিসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রায় প্রতিটি নাটকে তিনি ছিলেন অপরিহার্য শিল্পী।
১৯৬৭ সালে মিজানুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকায় এসে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।
স্নাতক শেষ করার আগেই ন্যাশনাল জুট মিলে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি টেলিভিশন ও রেডিওর নাটকে নিয়মিত অভিনয়ও করতেন। মিজানুর রহমান অবিবাহিত ছিলেন।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info