
এক ছিল রাখাল বালক। বনের ধারে সে গরু চরাত।
একদিন সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ এসেছে বাঘ।’
গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এল, হাতে লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল। এসে দেখল, রাখাল বালক হাসছে। বাঘ আসলে আসেনি। সে মজা করছিল।
কয়েক দিন পরে আবারও সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ, বাঘ।’
সহজ-সরল গ্রামবাসী। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসে। তারা আবারও দৌড়ে এল বনের ধারে—এসে দেখল রাখাল বালক হাসছে।
তারা আবারও ‘ডজ’ খেয়ে ফিরে গেল যার যার কাজে।
মাস খানেক পরে আবারও চিৎকার করে উঠল সেই রাখাল বালক। ‘বাঘ এসেছে বাঘ’।
গ্রামবাসী আবারও ছুটে এল রাখাল বালকের উদ্ধারে। এসে দেখল, রাখাল বালক হাসছে। তোমাদের কী রকম ঠকালাম। আসলে বাঘ আসেনি।
তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এল। রাখাল বালক তারস্বরে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল—বাঘ এসেছে বাঘ।
গ্রামবাসীর কেউই আর এগিয়ে এল না। কতবার আর ঠকা যায়।
বাঘ খেয়ে ফেলল রাখাল বালকটিকে।
এই উপদেশমূলক গল্পটা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি।
এবং এই গল্পের শেষের উপদেশটাও আমরা জানি, সদা সত্য কথা বলিবে, কখনো মিথ্যা বলিয়ো না।
গল্প লেখা শেখার ক্লাসে অবশ্য এই রাখাল বালকটিকে খুব সম্মান করা হয়। বলা হয়, এই রাখাল বালক হলো পৃথিবীর প্রথম গল্পকার। কারণ, সে বানিয়ে একটা বাঘের চরিত্র সৃষ্টি করেছিল। একটা বাঘকে সে কল্পনা করতে পেরেছিল। কাজেই তাকে গল্পকারের সম্মান দেওয়া হোক।
আমেরিকার বাচ্চাদের একটা স্কুলে একজন শিক্ষক এই গল্পটি বললেন। তারপর বললেন, এই গল্প পড়ে তোমরা কী শিখলে?
একজন বলল, এই গল্প পড়ে শিখলাম, শিশুশ্রম ভালো নয়। একজন বালককে কেন গরু চরাতে হবে। বাঘ যেখানে আছে, এই রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কেন একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে করতে দেওয়া হলো। গ্রামবাসী কাজটা ঠিক করেনি। তাই তো ছেলেটি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সব দোষ গ্রামবাসীর।
একজন বলল, এই গল্প থেকে আমরা শিখলাম, সত্য কথা বললে বাঘের পেটে যেতে হয়। ছেলেটা যতবার মিথ্যা কথা বলেছিল, ততবার মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। সে মাত্র এক দিন সত্য কথা বলেছিল। সেদিন কেউ তার বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কাজেই সত্য কথা বলতে হয় না। কৌশলী হতে হয়। মিথ্যা বলতে হয়।
এই শেষ উক্তিটি শুনে আমি থ। ভেবে দেখলাম, তাই তো। ঘটনা তো ঠিক। রাখাল বালক যখন মিথ্যা কথা বলছিল, সবাই তাকে বিশ্বাস করেছে, সবাই তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। একটা দিন মাত্র সে সত্য বলল। আর সেই দিনই কিনা কেউ তার উদ্ধারে এগিয়ে এল না।
এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি।
শিশুরা যেকোনো বিষয় একেবারে নতুনভাবে দেখতে জানে। তাদের কাছ থেকে পরিস্থিতির নতুন ব্যাখ্যা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়।
ইশপের রাখাল বালকের এই গল্পটির নতুন ব্যাখ্যা আমাদের মনে নানা ভাবনা উসকে দিয়েছে।
এই গল্পের আরেকটা মেসেজ বা উপদেশ বা বার্তা আছে, যা বড়দের জন্য। জাতীয় জীবনেও সব সময় নেতারা বলতে থাকেন, আপনাদের সামনে বিপদ, বাঘ এসে গেছে। তারা কাল্পনিক সব বিপদের সংকেতধ্বনি বাজাতে থাকেন। ফলে জনগণ বুঝতে পারে না, কোনটা আসল বিপদ। কোনটা নকল বিপদ। কখন আসলেই তাদের সাবধান হওয়া উচিত। কোন অ্যালার্মটা ভুয়া, কোনটা আসল।
এদিকে আমেরিকানরা এক গবেষণায় দেখেছে, ইশপের এই গল্পটা বাচ্চাদের মিথ্যা কথা বলতে উৎসাহ জোগায়। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন যে ছোটবেলায় চেরিগাছ কেটে ফেলে তাঁর বাবাকে সাহসের সঙ্গে বলেছিলেন, এটা তিনিই কেটেছেন, সেই ঘটনা শিশুদের সত্য কথা বলতে উৎসাহিত করে।
যেমন আমাদের ছোটবেলায় ক্লাস ওয়ানের বইয়ের টোনাটুনি পিঠা বানানোর গল্পটা ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল। ওই গল্পে টোনা আর টুনি পিঠা বানাচ্ছিল, বনের পশুপাখি সেই পিঠার গন্ধ পেয়ে কাছে এলে সবাইকে তারা বলেছিল, বিকেলে এসো, তোমাদেরও ভাগ দেব। বিকেলের আগেই টোনা আর টুনি পিঠা রেঁধে খেয়ে বেগুনগাছ ছেড়ে একটা উঁচু বড় গাছে উঠে বসে রইল। বনের পশুপাখি বিকেলে এসে দেখল—কই, টোনাও নেই, টুনিও নেই, পিঠাও নেই। তারা মন খারাপ করে ফিরে গেল। টোনা আর টুনি গাছের মগডালে বসে ডেকে উঠল, টুন টুন টুন।
এটা শিশুদের মিথ্যা বলতে শেখায়। তাই এই গল্প আর পড়ানো হয় না।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের নেতারা যে সারাক্ষণ আমাদের মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছেন, মিথ্যা আশ্বাসও দিচ্ছেন, সেটা কি ভালো না খারাপ?
দেশে চলছে চাপাতি দিয়ে খুন।
এটা কে করছে?
আমাদেরকে দুটো উত্তর শোনানো হয়েছে।
১) এটা করছে জামায়াত-বিএনপি।
২) এটা করছে আওয়ামী লীগ।
হয় এই দুটো অভিযোগের দুটোই মিথ্যা, নয়তো একটা মিথ্যা, নয়তো দুটোই সত্য।
যদি দুটোই মিথ্যা হয়, তাহলে কি আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনারা কেন মিথ্যা কথা বলেন।
যদি দুটোই সত্য হয়, তাহলে কি আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনারা আমাদের মারছেন কেন?
যদি একটা সত্য একটা মিথ্যা হয়, তাহলে আমরা কি বলতে পারি, আপনারা আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা, আমাদের কান্ডারি, আপনাদের একজনেরও কি মিথ্যা বলা উচিত?
এই অবস্থায় আমরা যারা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মতো আপনাদের আচার- আচরণ থেকেই শিখতে চাই, তারা কী শিখব? আমেরিকার ওই স্কুলছাত্রের মতো আমরা বলব, দেখা যাচ্ছে, যাঁরা মিথ্যা কথা বলেন, তাঁরা বড় বড় আসনে থাকেন। তুমি সত্য কথা বলে নিচে পড়ে রইবে নাকি মিথ্যা কথা বলে ওপরে উঠবে, সিদ্ধান্ত তোমার।
সমস্যাটা হলো, আপনারা যখন এর বিরুদ্ধে ও, ওর বিরুদ্ধে এ, কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন, তখন আমরা নিজের প্রাণটুকু নিয়ে কী করব, কার কাছে যাব, কোথায় পালাব, বুঝতে পারছি না। ইশপের গল্পের বৃদ্ধ ভেকের মতোই আমাদের বলতে হচ্ছে, আপনাদের জন্য যা ছেলেখেলা, আমাদের জন্য তা জীবন–মরণ সংকট।
দয়া করে কথা কম বলুন।
কাজ বেশি করে করুন।
আপনারা শতবর্ষী হোন। আমাদের আপনাদের বয়স পর্যন্ত পৌঁছাতে দিন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।