মুজিবকে শান্তিতে থাকতে দেননি ভুট্টো
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে ছাড়া পান, সেদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রাখেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার দেশের মানুষের সঙ্গে কথা না বলে আমি কোনো আশ্বাস দিতে পারছি না।’ ভুট্টো তারপরও হাল ছাড়েননি। তিনি লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান কাজী ফয়েজ মোহ্ম্মদকে। তিনিও বঙ্গবন্ধুকে একই অনুরোধ জানান। জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজী সাহেব, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’ ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি বলেন, ‘তোমরা সুখে থাক। পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ এরপর ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার যখন ভুট্টোর সঙ্গে ইসলামাবাদে দেখা করেন, তিনি জানান, মুজিব তাঁকে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসূত্র রাখার আশ্বাস দিয়েও কথা রাখেননি। পরে কুলদীপ নায়ার ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো মিথ্যেবাদী। তিনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন, এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাই বলে মিথ্যে বলার অধিকার তাঁকে কেউ দেয়নি।’
উল্লেখ্য, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা ত্যাগের আগে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরোয়ানায় সই করলেও তা কার্যকর করতে পারেননি। তার আগেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদের আবেদন করলে ভুট্টো বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ। ভুট্টোর এই আচরণে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হন। ১৫ জানুয়ারি লন্ডনের অবজারভার–এর গ্যাভিন ইয়ংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেব এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করব। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেব...।’
এই সাক্ষাৎকারে মুজিব বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘেরও দায়িত্ব আছে বলে উল্লেখ করেন।
দুই.
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভ্রাতৃপ্রতিম মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেন। একই সঙ্গে তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সব সদস্য এবং তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি অনুরূপ আহ্বান জানান। তিনি ‘বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল ও ১৫ মিলিয়ন গজকাপড় পাঠানোরও নির্দেশ দেন। (হু কিলড মুজিব, এ এল খতিব)।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি চক্র প্রথমে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিল। সেই ঘোষণায় উৎসাহিত হয়ে
ভুট্টো নতুন সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
ভুট্টোর এই পদক্ষেপ ছিল একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রাখেন। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’
দুই মাস আগে, ১৯৭৫-এর জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান , স্ট্যানলি উলপার্ট)
মুসলিম লীগের নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর কারাগারে ছিলেন, তিনি ভুট্টোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে শুরু হোক।’
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সাংবাদিক জেড এ সুলেরি বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারত না যদি মুজিব বেঁচে থাকতেন।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই ভুট্টো বাংলাদেশ–বিরোধিতার প্রচারণা চালাতে থাকেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। এ ব্যাপারে তিনি পাকিস্তানে অবস্থানরত কথিত বাঙালি নেতাদের ও রাজা ত্রিদিব রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অপপ্রচার চালিয়েছেন, বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মকর্ম পালন করতে দেওয়া হয় না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী কামাল হোসেন এই নিবন্ধকারকে বলেছেন, ‘আমরা যেখানে যেতাম, এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম।’
বাংলাদেশের ভেতরে যাঁরা শেখ মুজিবকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, ভুট্টো তাঁদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা আবদুল হক একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালান। আর অর্থ ও অস্ত্রের জন্য ধরনা দিলেন পাকিস্তানের কাছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে এক চিঠি লেখেন তিনি। চিঠির ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
পুতুল মুজিব চক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়ারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।’
১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবদুল হক লিখিত চিঠিটি ভুট্টোর কাছে পৌঁছায় ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। চিঠিটি পাওয়ার পর তিনি ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে মন্তব্য করেন এবং এই ‘সৎ লোকটি’কে (আবদুল হক) ‘কার্যকর সাহায্য দেওয়ার সুপারিশ করেন।
আবদুল হক চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সিলেটের মাহমুদ আলীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাহমুদ আলী দখলদার পাকিস্তানিদের পক্ষ নেন এবং এর ইনাম হিসেবে ভুট্টো তাঁকে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত (তাঁদের ভাষায় পূর্ব পাকিস্তান) বিশেষ উপদেষ্টার পদে বসান।
ভুট্টোর আরেকজন এজেন্টের নাম আবদুল মালেক। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে তিনিও সৌদি আরব যান। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি ভুট্টোকে চিঠি লেখেন ‘আমার প্রিয় নেতা’ সম্বোধন করে।
এই চিঠির জবাবে ভুট্টো ধর্মমন্ত্রী মাওলানা কায়সার নিয়াজীকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে পাঠান। উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক, আর্থিক সাহায্য তথা অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা। ভুট্টো ভেবেছিলেন, এঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন
করে ইসলামি রিপাবলিক নামকরণের জন্য মুজিব সরকার কিংবা তাঁর উত্তরসূরির প্রতি (তখনই তাঁরা উত্তরসূরি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল!) চাপ সৃষ্টি করা।
স্ট্যানলি উলপার্টের বইয়ে আছে ‘দুই বছর যাবৎ ভুট্টো কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তাঁর গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থসাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং এর বিনিময়ে ফল লাভ করেছিলেন।’ ২০০০ সালে স্ট্যানলি উলপার্টের ঢাকা সফরের সময় লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বিনিময়ে ফল লাভ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? মুজিব হত্যায় কি পাকিস্তান জড়িত ছিল?’ উলপার্টের উত্তর, ‘হ্যাঁ, আপনি তা বলতে পারেন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল, র্যা ডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, ২০০৮)
আগামীকাল: যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে তৎপর পাকিস্তান
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com