কলকাতার চিঠি

যশোর রোডের শতবর্ষী বৃক্ষের কথা

যশোর রোডের সেই গাছগুলো
যশোর রোডের সেই গাছগুলো

উপমহাদেশের এক পরিচিত নাম যশোর রোড, এক ঐতিহাসিক সড়ক। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে এই সড়ক। শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে, যা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কলকাতায় গিয়ে মিশেছে। সেই যশোর রোড নিয়ে কত কাহিনি, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস। এই রোড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। এই রোডের পাশে কত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল। এই রোড ঘুরেছেন অনেক নেতা, কবি-সাহিত্যিকেরা। সেই যশোর রোডের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গৌরব আজও উজ্জ্বল। এখন যশোর রোড চওড়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সড়কের মর্যাদা পেয়েছে। আজও যশোর রোডের দুই পাশের শতবর্ষী বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বৃক্ষরাজিই আজ যশোর রোডের গর্ব।

কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বৃক্ষ কেটে সরকার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, যদিও শেষমেশ আন্দোলন ও আদালতের হস্তক্ষেপের পর সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাঁরা দাবি তুলেছিলেন, শতবর্ষী বৃক্ষ ধ্বংস নয়। পরিবেশ বাঁচাতে তাদেরও বাঁচাতে হবে; ইতিহাস মুছে নয়, ইতিহাস রক্ষা করে। তাই তো বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দুই দেশেই পৃথকভাবে আন্দোলন করেছেন এই বৃক্ষরাজিকে বাঁচাতে। দাবি তুলেছেন, পেট্রাপোল (হরিদাসপুর) সীমান্ত থেকে কলকাতায় আসতে যশোর রোডের এই শতবর্ষী বৃক্ষরাজিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ঐতিহাসিক বৃক্ষ সড়কের মাঝে রেখে যেভাবে রাস্তা চওড়া করা হয়েছে, সেভাবেই তৈরি করা হোক গোটা যশোর রোডকে। আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার তা মেনে নিয়েছে। আমরা চাই, যশোর রোড পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠুক।

ইতিহাস বলছে, যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাবড়া-বারাসাত পার হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই ১২৫ কিলোমিটারের যশোর রোড। বাংলাদেশের অংশটুকু যশোর-বেনাপোল সড়ক নামে পরিচিত হলেও পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে একেবারে কলকাতা বিমানবন্দর ছাড়িয়ে নাগের বাজার হয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই সড়ককে যশোর রোড নামেই জানে মানুষ। সাইনবোর্ডে কোথাও কোথাও এই যশোর রোডের নাম চোখে পড়ে। এই বিস্তৃত যশোর রোডের ৩৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা পশ্চিমবঙ্গে।

একাত্তরে এই যশোর রোডের আশপাশের সেই চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর, গোবরডাঙ্গা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা আর অশোকনগরে বাংলাদেশিদের ঠাঁই হয়েছিল সড়কের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে একাত্তর সালে লিখেছিলেন কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এই যশোর রোড দিয়েই একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত করতে গিয়েছিলেন অস্থায়ী বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। সেই যশোর রোড আজও ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

এবার যশোর রোডের ইতিহাস জানতে একটু পেছনের দিকে ফেরা যাক। সম্রাট শের শাহ্ ১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সোনারগাঁ থেকে আজকের পাকিস্তান পর্যন্ত তৈরি করেন গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা ছুঁয়ে লাহোর-পেশোয়ার অবধি চলে গেছে এই রোড। আবার ইংরেজদের বাংলা দখলের আগে সংস্কারের অভাবে এই রোড মেঠো পথে পরিণত হয়। তখন দস্যু-তস্করের হামলার ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই পথ দিয়ে চলাচল করতেন রাজকর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা। তখন যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। যশোর জেলা হওয়ার পর এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। তখন যশোরে গড়ে ওঠা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদের কাছে গঙ্গাস্নান পুণ্যের কাজ। সেই সময় যশোর থেকে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন। আবার কেউ কেউ পালকিযোগেও যেতেন। যেতেন বনগাঁ হয়ে চাকদহের গঙ্গার ঘাটে। যশোর থেকে চাকদহের দূরত্ব ছিল ৮০ কিলোমিটার।

সে সময় যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। উদ্বিগ্ন পুত্র দরজা খোলার অনুরোধ জানালে মা শর্ত দেন, গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। ফলে এই রাস্তাকে অনেকে কালী বাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করেন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর অকল্যান্ড এই সড়ক নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন, যার নির্মাণকাজ ১৮৪৫ সালে শেষ হয়। আর তখন এই সড়কের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রচুর শিশুগাছ লাগানো হয়। সেই গাছই আজ শতবর্ষী গাছের তকমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডজুড়ে।

এখন কেমন আছে সেই যশোর রোড আর যশোর রোডের শতবর্ষী বৃক্ষ, তা স্বচক্ষে দেখতে গত মঙ্গলবার ছুটে গিয়েছিলাম পেট্রাপোল বা হরিদাসপুর সীমান্তে। দেখলাম, যশোর রোডজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত সুউচ্চ বৃক্ষ।

আমরা পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে যখন পেট্রাপোলের যশোর রোড ধরে কলকাতায় ফিরছি, তখন চোখে শুধু সেই ইতিহাস ভেসে উঠল-বৃক্ষরাজি। এখন পেট্রাপোল থেকে জয়ন্তীপুর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তার যশোর রোডের ঐতিহাসিক বৃক্ষ না কেটে সড়কের ডানে তৈরি করা হয়েছে বর্ধিত সড়ক। ফলে ডানপাশের বৃক্ষরাজি চলে আসে রাস্তার মাঝে। আর রাস্তা দুই দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সোজা রাস্তা চলে গেছে একেবারে শ্যামবাজার পর্যন্ত। কিন্তু আমরা পেট্রাপোল থেকে জয়ন্তীপুর, ছয়ঘরিয়া, চাঁদপাড়া, বকচরা, গাইঘাটা, বাঘনা, গোপালপুর, কলাসীমা, অশোকনগর, মানিকতলা, চালতাবেড়িয়া, তেঁতুলতলা, রসুলপুর, দীঘার মোড় হয়ে কলকাতার দিকে যত এগোচ্ছি আর আমাদের চোখে পড়ছে শতবর্ষী গাছ; যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডের দুই পাশে। এই বিশাল গাছের গায়ে এখনো গ্রামের মানুষ গোবর দিয়ে তৈরি করা ঘুঁটে শুকাচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক যে পেট্রাপোল বা হরিদাসপুর থেকে অশোকনগর পর্যন্ত এই সড়কে অগণিত শতবর্ষী গাছ থাকলেও অশোকনগর থেকে বারাসাত পর্যন্ত পুরোনো গাছ কিছুটা কম। তবে এখানে চোখে পড়েছে পুরোনো গাছের সঙ্গে বহু নতুন গাছ।

বাংলাদেশ সরকার পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী রাস্তাটির পুরোনো গাছ কাটা থেকে সরে আসার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।