Thank you for trying Sticky AMP!!

যে কারণে মাটিতে নামা প্রয়োজন

অবারিত গতি আর পাখির চোখে পৃথিবী দেখার মজা ঢের। কিন্তু তা ছেড়ে আকাশচারীও খোঁজে মাটির ছোঁয়া। বেলা শেষে পাখি খোঁজে নীড়। মানুষ খোঁজে তার আপনজন। শিকর, শিকড় ও শিখরের রয়েছে মেলবন্ধন। উচ্চতা যতই হোক, বৃক্ষের শিকড়ই সব। মহাসাগর যত বড় হোক, শিকরই (জলকণা) তার অকৃত্রিম অস্তিত্ব।

মানুষ নিজের যোগ্যতা ছাপিয়ে যত শীর্ষে যাক, দিন শেষে সে পরিবারের অংশ। মানুষ জন্মগতভাবে পৃথিবীর অন্যতম আদিম এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য। সাময়িক এই সংঘ থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিলেও প্রান্ত বদলে আবার এমন সংঘই তাকে গড়ে নিতে হয়। এটা না পারলে বাধে যত বিপত্তি। দেখা দেয় হতাশা। পরিণতি ভয়ংকর, বেদনার।

মানুষ কেন হিংস্র হয়? কেন চুপসে যায়? কেন নিজেকে হরণ করে নেয়? মোটাদাগে সব কটি প্রশ্নের উত্তর—একটি সুন্দর পরিবার গড়তে না পারা বা একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবারের সদস্য হতে না পারা।

অভাব, অনটন, রোগশোক নিয়েই মানবসংসার। তাই বলে সমস্যাগ্রস্ত সব পরিবারের সদস্য হিংস্র হয় না, অন্যের ক্ষতি করে না, প্রাণচাঞ্চল্য হারায় না বা নিজের জীবনের প্রতি চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা দেখায় না। হৃদ্যতা বলতেও একটা কথা আছে। যে সংসারে হৃদ্যতা থাকে, বোঝাপড়া থাকে; সেই সংসারে চূড়ান্ত অনটনের মধ্যেও থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা। দিন শেষে তারা নিজেদের মতো করে সফল হয়।

পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করার স্লোগান সামনে রেখে ১৫ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রসার, নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও সংখ্যানুপাতিক হারে জীবিকার তারতম্যে ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার। অনেকেই বলছেন, এর শুরুটা ১৭৫০-১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শিল্পবিপ্লব ঘটার সময় থেকে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিবার গঠনে অনীহা ও অপ্রয়োজনীয় বিচ্ছেদ যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছেদের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা। আবার বাংলাদেশে দিন দিন মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ, পারিবারিক জটিলতা ও অণুপরিবার গঠনের প্রবণতা।

Also Read: পড়ন্ত বেলায় সন্তান কেন নির্ভরতার আশ্রয় হয় না

বর্তমানে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন যেন ষড়ঋতুকেও হার মানাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে সকাল-বিকেল। কখনো পূর্বাভাস দিয়ে পাল্টাচ্ছে, আবার কখনো না দিয়েই। অথচ এখানে দরকার স্থিতিশীলতা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বিষণ্নতা। কয়েক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ঢাকায় একটি জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের ১৮ শতাংশের বেশি ভুগছে বিষণ্নতায়। অথচ মনোবিদেরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন না থেকে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ালে, সৎ সঙ্গে থাকলে, প্রিয়জনদের কাছে পেলে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এদিকে পরিবারের সঙ্গীহারা বয়োজ্যেষ্ঠরা যদি পুনরায় সঙ্গী খুঁজতে চান, সে ক্ষেত্রে অনুজদের এগিয়ে আসা উচিত।

মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অনেক
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর পাস হওয়া মা-বাবার ভরণপোষণ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। এখানে ভরণপোষণ বলতে শুধু খাওয়াদাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা বোঝানো হয়নি; বরং তাঁদের ‘সঙ্গ’ দানের কথাও বলা হয়েছে। এমনকি এ আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, বাবার অবর্তমানে দাদা-দাদি এবং মায়ের অবর্তমানে নানা-নানির ভরণপোষণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।

ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক ১৯৭২ সালে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জাতীয় উন্নয়নের ‘মাপকাঠি’ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ‘মোট জাতীয় সুখ’ (জিএনএইচ) সামনে নিয়ে আসেন। তিনি ঘোষণা দেন, জিডিপির চেয়ে জিএনএইচ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অক্সফোর্ড পোভাটি৴ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (ওপিএইচআই) মতে, জিএনএইচ টেকসই উন্নয়ন অগ্রগতির ধারণার ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পাশাপাশি সুখের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অ-অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে। ভুটান ৯টি ডোমেইনের আওতায় ৩৩টি ইন্ডিকেটরের (নির্দেশক) মাধ্যমে তাদের জিএনএইচ নির্ণয় করে থাকে। তাদের ডোমেইনগুলো হলো মানসিক সুস্থতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সময় ব্যবহার, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা, সুশাসন, সম্প্রদায়ের প্রাণশক্তি, পরিবেশগত বৈচিত্র্য ও স্থিতিস্থাপকতা এবং জীবনযাত্রার মান।

Also Read: গণবিচ্ছিন্নতাই কি আধুনিকের নিয়তি

বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সুশাসন ও মানসিক সুস্থতা বিশেষভাবে উপেক্ষিত। এ কারণে মাথাপিছু গড় আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠিতে পিছিয়েই আছে। উল্লেখ্য, সুশাসন শুধু আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয় নয়; এটি একটি পারিবারিক বিষয়ও। কারণ, এর সঙ্গে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের সম্পর্ক রয়েছে।

ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনাটি অনেককে নাড়া দিয়েছে। চলছে তাঁর ১৬ মিনিটের কথা আর চিরকুটের বিশ্লেষণ। তিনি বিভিন্নভাবে পারিবারিক হতাশার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত নিউজগুলোয় অনেক পাঠক মন্তব্য করেছেন।

সেখানে এক পাঠকের মন্তব্য ছিল এমন, ‘আহা জীবন! কিছু মানুষ না খেয়ে থাকলেও এমনটা ভাবে না। আর এত বড় বাড়ি, সম্পদ, খাবার তবুও এত হতাশা!...এমন চিন্তা আর কেউ করবেন না, প্লিজ। সমাজে আমরা আছি, বহু স্বেচ্ছাসেবক আছেন। তাঁদের সঙ্গে মিশুন। সময় দিন। অন্য এক জীবন দেখবেন। আলোকিত জীবন।’ পাঠকের এই মন্তব্যের শেষের কথাগুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি। তাঁর কথাগুলোর মধ্যে সামাজিক পুঁজির (সোশ্যাল ক্যাপিটাল) ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, অর্থনৈতিক পুঁজি থাকে ব্যাংকে, মানবপুঁজি (হিউম্যান ক্যাপিটাল) থাকে মাথায় এবং সামাজিক পুঁজি মানুষের সম্পর্ক কাঠামোর মধ্যে। একজন মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার জন্য সামাজিক পুঁজি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট ডেভিড পুটনাম বলেছেন, পারস্পরিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধচর্চার মাধ্যমে সুফল ভোগ করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এ হার প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এই উদ্বেগ ছড়িয়ে গেছে ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করা শেরপুরের নালিতাবাড়ীর কৃষক সফি উদ্দিন পর্যন্ত। মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল তাঁর এক নিবন্ধে বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে নগরায়ণের বিস্তার ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কথা বলেছেন।
আমাদের দেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে।

সুস্থ নগরায়ণ না হলে এর পরিণতি ভয়াবহ। বিশেষ করে তাতে সামাজিক শান্তি তলানিতে পৌঁছায়। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। অসুস্থ নগরায়ণের সঙ্গে কিছু বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে দ্রুত অর্থ উপার্জন, মাদক, অস্ত্রবাজি, হত্যা, যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতা অন্যতম। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতায় বখে যেতে পারে পরিবারের অবুঝ শিশুটিও। তৈরি হতে পারে ঐশীর মতো কেউ। ঐশীদের দোষ দেওয়ার সুযোগ নেই। পরিবর্তন করতে হবে আমাদের পরিবার ও সমাজকাঠামোকে।

আমরা মাটিতে নামতে চাই। শিকর ও শিকড়ের সঙ্গে থাকতে চাই। শান্তি চাই। শান্তি!—যা হবে বিত্তবৈভব আর ঝিকিমিকি আলোর অনেক ঊর্ধ্বে।

মো. ছানাউল্লাহ, প্রথম আলোর সহসম্পাদক