Thank you for trying Sticky AMP!!

শব্দে আর জব্দ না হোক নারী


কিছুদিন আগে এক কর্মশালায় লিঙ্গ-সংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা হচ্ছিল। অসংবেদনশীল ভাষার ব্যবহার একজন নারীর সামাজিক অবস্থানকে কীভাবে দুর্বল করে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কর্মশালায় অংশ নেওয়া প্রায় শতভাগ নারী বিষয়টির সঙ্গে তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পান। কিন্তু অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পুরুষ লিঙ্গ-সংবেদনশীল ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি তোলাকে অতিরঞ্জিত ও বাড়াবাড়ি বলে দাবি করেন। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন, এ ধরনের আলোচনা নারী ও পুরুষের বিভেদকে আরও উসকে দেয়। অনেকে মনে করেন, শব্দের প্রয়োগ নয়, বরং শব্দ প্রয়োগের পেছনে ব্যবহারকারীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। যদি শব্দ প্রয়োগের পেছনে ইতিবাচক মানসিকতা কাজ করে, তবে কী দরকার শব্দগুলো নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার?

আমার অভিজ্ঞতা বলে, নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিষয়টিকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, অস্বীকার করার উপায় নেই, কাউকে ওপরে ওঠানোর কিংবা নিচে নামানোর অন্যতম বড় অস্ত্র হলো ভাষা। ভাষা যেমন একদিকে মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম, ঠিক একইভাবে তা কিন্তু আবার শোষণ, বৈষম্য আর নির্যাতনেরও মাধ্যম। শব্দ নির্বাচন আর প্রয়োগের রাজনীতি যুগে যুগে নির্ধারণ করেছে মানুষের সামাজিক অবস্থান। যেহেতু ভাষা সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়, তাই কোন সমাজে নারীর অবস্থান কেমন, তা বোঝা যায় সেই সমাজে নারীর প্রতি ব্যবহার হওয়া ভাষার মাধ্যমে।

অপ্রত্যাশিত ও অসংবেদনশীল শব্দের আঘাতেই সবচেয়ে বেশি জর্জরিত হন নারী। চলতি পথে, বাসের ভিড়ে, সহকর্মীদের আলোচনায়, পারিবারিক সমালোচনায়, বন্ধুদের আড্ডায় বুঝে কিংবা না বুঝে নারীর প্রতি যে অসংবেদনশীল ভাষার প্রয়োগ করা হয়, তার অধিকাংশই নারীর লিঙ্গ, যৌনতা, কর্মদক্ষতা কিংবা যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই উচ্চারিত হয়। এ শব্দগুলো যে শুধু পুরুষ ব্যবহার করেন, তা কিন্তু নয়; নারীরাও প্রায়ই তাঁদের সম্মানের প্রতি চরম অবমাননাকর এসব ভাষার প্রয়োগ করেন খুব স্বাভাবিকভাবে, চিন্তাভাবনা না করেই। এই অবমাননাকর ভাষাগুলো আমাদের দৈনন্দিন শব্দভান্ডারে এমনভাবে মিশে আছে যে তা প্রয়োগ করার আগে আমরা নিজেরাও তলিয়ে দেখি না এসব ভাষা কীভাবে আমাদের নিজেদের কিংবা আমাদের আপনজনকে অপমানিত করছে।

বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি কিংবা শব্দ সাধারণত নারীকে অবমাননা কিংবা হয়রানি করার জন্যই ব্যবহৃত হয়। অবাক হই, তিরস্কারমূলক নারীবাচক অনেক শব্দের বিপরীতে পুরুষবাচক কোনো শব্দের অস্তিত্বই নেই। ‘মুখরা’, ‘ঝগড়াটে’, ‘মাল’, ‘বন্ধ্যা’, ‘পোড়ামুখী’র মতো শব্দগুলোর বিপরীতে পুরুষবাচক শব্দ খুঁজে পাওয়া ভার। অন্যদিকে, ‘ডাইনি’, ‘বেশ্যা’, ‘ছিনাল’, ‘খানকি’, ‘কুটনি’র মতো শব্দগুলো সব সময় নারীকে নেতিবাচকভাবে বর্ণনা করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘটনার সঙ্গে নারীর ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকলেও তাঁকে হেয় করে ‘জন্ম নেওয়া’ গালি ব্যবহৃত হতে থাকে বিনা সংকোচে যুগের পর যুগ।

মনে রাখা প্রয়োজন, ভাষা কিন্তু সমাজে বৈষম্য টিকিয়ে রাখার অন্যতম বড় হাতিয়ার। শব্দ নির্বাচন ও ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে মিশে থাকে ক্ষমতার রাজনীতি। তাই ভাষাকে শুধু নিছক শব্দসম্ভার বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হরহামেশা ব্যবহৃত গালিগুলোর প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায়, সেগুলো সুস্পষ্টভাবে পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ২০১৭ সালে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের একটি গবেষণায় দেখা যায়, শহরাঞ্চলে ৮৮ শতাংশ নারী পথচারী কর্তৃক আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হন। গ্রামাঞ্চলে নারীকে কেন্দ্র করে গালি দেওয়া হয় আরও বেশি।

অ্যাকশনএইড প্রায় ২ হাজার ৮০০ কেসের ওপর গবেষণা করে দেখেছে, প্রতি তিনজনে একজন নারী সহিংসতার শিকার হন। গবেষণায় বলা হয়, শারীরিক নির্যাতনের সময় মৌখিক নির্যাতনের বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী। আর মৌখিক নির্যাতনের অন্যতম বড় উপায় হলো গালির ব্যবহার ও আপত্তিকর শব্দের প্রয়োগ। এর পাশাপাশি নারীর যোগ্যতা, সক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে কৌতুক, চটুল শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি তো রয়েছেই।

একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, অনেক পুরুষবাচক শব্দের বিপরীতে নেই নারীবাচক শব্দের উপস্থিতি এবং অনিবার্যভাবেই এই পুরুষবাচক শব্দগুলোর সঙ্গে ক্ষমতা ও আধিপত্যের একটি যোগসূত্র রয়েছে। উপযুক্ত স্ত্রীবাচক শব্দের অনুপস্থিতিতে অনেক নারীকেই পুরুষবাচক এসব শব্দের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে বৈষম্যমুক্ত জেন্ডারনিরপেক্ষ শব্দের মারাত্মক অভাব। আবার জেন্ডারনিরপেক্ষ যে শব্দগুলো আছে, সেগুলোও আমাদের সচেতনতার অভাবে ব্যবহৃত হয় না। ফলে, রাষ্ট্রপতি কিংবা সভাপতির মতো প্রচলিত পুরুষবাচক শব্দগুলো তাদের আধিপত্য ধরে রাখে।

মনে রাখতে হবে, নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার নারীর অগ্রযাত্রাকে অনেকখানি থামিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, অসম্মানজনক ভাষার ব্যবহার নারীর আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেন শব্দচক্রে জর্জরিত নারীর জীবন। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। তাই মায়ের সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভাষায় নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করা খুব জরুরি। এই ভাষার মাসে আমাদের প্রতিশ্রুতি হোক শব্দে আর জব্দ না হোক নারীর জীবন।

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com