কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন,
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরও ছটা
এত শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।
আলমারির প্রথম তাকে সে রাখল সব নীল শাড়ি
হালকা নীল একটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় তাকে রাখল সব গোলাপি শাড়ি
অতনু নন্দী লিখেছেন,
হলুদ শাড়ি, হলুদ শাড়ি
আয় না তোকে জড়িয়ে ধরি
থাকবি আমার হৃদয় মাঝে
হয়ে যে তুই স্বপ্নপরি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতাতেও রয়েছে শাড়ির কথা— ‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া—
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’
সদ্য প্রয়াত শিল্পী লাকী আখান্দের সুরে হ্যাপী আখান্দ্ গেয়েছিলেন, ‘নীল নীল শাড়ি পরে...এসেছ এ অভিসারে...নাচো না দেখি ধীরে ধীরে লাজুক লাজুক পা ফেলে’
শাড়ি নিয়ে এ রকম রয়েছ আরও বহু গান ও কবিতা। শাড়িবন্দনা হয়েছে যুগে যুগে। বাঙালি নারীর অন্যতম পোশাক শাড়ি। বাংলায় শাড়ির ব্যবহার সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের শাড়ির প্রচলন ছিল। ১২ হাত দৈর্ঘ্যের এ কাপড় অনেক নারীর খুব প্রিয় এক পোশাক। শাড়িশোভন নারী পুরুষেরও অতি পছন্দের, তা পুরুষদের লেখা গল্প-কবিতায় শাড়িবন্দনা দেখেই অনুমান করা যায়। কত রকমের শাড়িই না রয়েছে: সুতি, সিল্ক, জামদানি, বেনারসি, কাতান, জর্জেট, জারদৌসি, কাঞ্জিভরম, মসলিন। আমাদের রাজধানী ঢাকা তো একসময় মসলিন শাড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল।
কিন্তু শাড়ি কি আর আগের মতো জনপ্রিয় নেই? আজকের প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীদের অনুযোগ, মেয়েরা এখন শাড়ি পরেন কম, তাই শাড়ির ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। দেশি শাড়ির জায়গা দখল করছে ভারত থেকে আসা ঝলমলে শাড়ি। মেয়েরা শাড়ি পরলেও পরছেন বিদেশি শাড়ি। ফলে কমছে টাঙ্গাইল শাড়ির নিজস্ব বাজার।
ব্যবসায়ীদের অনুযোগটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনকার ব্যস্ত জীবনে ঠিকই মেয়েরা শাড়ি পরেন কম। বলা যায়, এখন সালোয়ার-কামিজের জয়জয়কার। বাড়িতে, অফিস-আদালতে মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরছেন বেশি। কর্মজীবী নারীদের বেশির ভাগই আর শাড়ি পরেন না। কারণ, তাঁদের কাছে সালোয়ার-কামিজ পরা অনেক বেশি আরামের। এই পোশাক পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করা যায়। চাইলে দৌড়ঝাঁপও করা যায়, শাড়ি পরে যা করা কঠিন। যেসব নারী গণপরিবহনে যাতায়াত করেন, তাঁরা তো শাড়ি পরার কথা কল্পনাই করেন না। অনেক মেয়ের কাছে শাড়ি পরে বাসে ওঠা আর এভারেস্টে ওঠা একই কথা। আর বাড়িতে শাড়ি পরা! সালোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সিতেই তাঁরা সেখানে বেশি স্বচ্ছন্দ। শাড়ি পরার ঝকমারিও তো কম নয়। কুচি ঠিক হয় তো আঁচল ঠিক হয় না। কখনো আঁচল ছোট হয়ে যায়, কখনো আবার এত বড় হয় যে তা মাটিতে লুটায়। এ ছাড়া পরতে সালোয়ার-কামিজের তুলনায় সময় লাগে বেশি। আরও হ্যাপা আছে। শুধু শাড়ি কিনলে তো হবে না, চাই ম্যাচিং ব্লাউজ আর পেটিকোট। অনেক শাড়িতে ব্লাউজ পিস দেওয়া থাকে। সেটা বানাতে আবার দরজিবাড়িতে যেতে হয়। এ ছাড়া শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ম্যাচিং গয়না তো লাগবেই।
তবে মা-খালা-ফুপুরা এখনো শাড়িই পরেন। কি ঘরে কি বাইরে, সব সময় তাঁদের পরনে শাড়ি। অবশ্য আমাদের দেশের তরুণীরা শাড়ি একবারই পরেন না—বিষয়টা এমন নয়। বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁরা শাড়ি পরে থাকেন। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষেও শাড়ি পরেন তাঁরা। যেমন: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সাদা-কালো শাড়ি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে লাল-সবুজ শাড়ি, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বেগুনি রঙের শাড়ি। আর পয়লা বৈশাখে লাল-সাদা শাড়ি পরা তো অবধারিত। যে মেয়ে সারা বছর কোনো শাড়ি পরেন না, সেই মেয়েও পয়লা বৈশাখে শাড়ি পরে নতুন বছরকে বরণ করেন। আর ঈদ উপলক্ষে বা পূজা উপলক্ষে শাড়ি তো পরা হয়ই।
নতুন একটি ট্রেন্ড বা চলের কথা হয়তো অনেকের অজানা। সেটা হচ্ছে, মেয়েরা আজকাল কোনো একটি শাড়ি পরে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেই শাড়ি আর অন্য কোনো অনুষ্ঠানে পরেন না। পরলেও এমন অনুষ্ঠানে পরা হবে, যেখানে আগের অনুষ্ঠানের অতিথিরা যাবেন না। আর ফেসবুকে কোনো শাড়ি পরে ছবি পোস্ট করলে সেই শাড়ি পরে দ্বিতীয় আর কোনো ছবি পোস্ট করা হবে না। কাজেই শাড়ি ব্যবসায়ীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা মেয়েরা আগের তুলনায় শাড়ি কম পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরার জন্য শাড়ি ঠিকই কিনি। শাড়ি কেনা বন্ধ হবে না কখনোই আমাদের। তবে শাড়ি দেশি হবে না বিদেশি হবে, তা বলতে পারব না। দেশি শাড়ি কিনতে মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক