Thank you for trying Sticky AMP!!

সংকটকালে পাশে দাঁড়ায়নি পরীক্ষিত বন্ধুরা

>

বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। পররাষ্ট্র ও কূটনীতির ক্ষেত্রে কেমন গেল বছরটি? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো কী কী ছিল? এসব নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতের চাওয়ার জায়গাগুলো অনেকটাই পূরণ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের চাহিদাসমূহ পূরণে ভারতের প্রতিশ্রুতি কোনোটাই বাস্তব রূপ লাভ করেনি। তবু বছর শুরু হয়েছিল দুই দেশেরই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এই উচ্চারণে যে বাংলাদেশ এবং ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’।

অনেকে আশা করছিলেন যে এপ্রিল-মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের পর এ ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি সম্ভব হবে। অন্তত তিস্তার বিষয়ে বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি হয়তো পালন করবে ভারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। শোনা যাচ্ছে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখলের আশা করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সুবিধা দিয়ে উত্তরবঙ্গের ভোট হারানোর ঝুঁকি নেবে না দলটি। বরাবরের মতোই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ।

এর মধ্যে জুলাই মাসে আসামের নাগরিক তালিকার দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হলো, যাতে ৪০ লাখ মানুষকে সম্ভাব্য বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। ৩১ আগস্ট বের হলো চূড়ান্ত তালিকা, যাতে ১৯ লাখ মানুষকে বলা হলো বিদেশি। ভারত আশ্বস্ত করল যে এটা নিতান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের এতে উদ্বেগের কিছু নেই। আমাদের সরকারও তাদের এই আশ্বাসে বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে। বাংলাভাষী এই মানুষগুলো যদি ভারতে বিদেশি বলে গণ্য হয়, তবে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে, ভারতের আশ্বাস বা আমাদের বিশ্বাসে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ৩ থেকে ৬ অক্টোবর চার দিনের ভারত সফরে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তখনো তাঁকে একই আশ্বাস দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ সফরকালে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের মধ্যে। তার একটির সুবাদে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের খাবার পানির সমস্যা মেটাতে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত। এ পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, তবে তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে এই ছোট সুবিধাও ক্ষোভের কারণ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে।

সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সপ্তমটির শিরোনাম ‘এমওইউ অন প্রভাইডিং কোস্টাল সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ (উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম প্রদানসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক)। এ স্মারকের শর্তাবলি বিষয়ে সরকারিভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে ভারতীয় পত্রিকার খবরে জানা যায়, এই সমঝোতা স্মারকের ফলে দিল্লি বাংলাদেশে একটি উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ পাবে এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লির রণকৌশলগত অবস্থান এতে শক্তিশালী হবে। সাগরপথে সন্ত্রাসী হুমকি এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটা হবে (ভারতের জন্য) খুবই উপকারী।

এই চুক্তি বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসবে এমন কোনো কথা কোনো পক্ষ থেকেই শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুসম্পর্কের আলোকে এ নিয়ে চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় এই স্মারক কোনো বিনিময় ছাড়াই ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারের একজন উপদেষ্টা অবশ্য এর পক্ষে একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন যে এরূপ একটি নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এটা করা হতো সময়সাপেক্ষ, তাই ভারতকে তা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে কেন এটা এত জরুরি হয়ে পড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। উদ্ভূত তথ্যের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ছাড়াও আমাদের বিদেশনীতিতে যে একধরনের ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা আছে, এই স্মারক তাতে আরও জটিলতাই সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে সর্বশেষ প্রভাবক ঘটনাটি ঘটেছে এই ডিসেম্বর মাসেই। অনেক হই–হট্টগোল আর তুমুল বিতর্কের পর ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল,২০১৯ পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী মুসলমানদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে নির্যাতিত হয়ে ভারতে চলে আসা হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে। বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোসহ সারা ভারতেই। বিক্ষোভ-সহিংসতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানিও ঘটেছে।

ভারতের পার্লামেন্টে পাস করা একটি আইন আপাতদৃষ্টিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দুটো কারণে এটিকে পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, আইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একই ব্রাকেটভুক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, আইনে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে (পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও) নির্যাতনের শিকার হয়ে সংখ্যালঘুরা ভারতে প্রবেশ করছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দুটি দেশ সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, তার একটি অপরটিকে আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, এটা একদিকে যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি অন্যদিকে বেদনাদায়ক। সাম্প্রতিক কালে ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের পুশ ইন তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগত কারণেই বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার ভারতের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, আর বহুদিন পর, সংযতভাবে যদিও সরকার সেই ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্ধারিত সরকারি সফর বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ককে তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করব? ভারতের কিছু অর্জন আছে, কিন্তু এক বছরে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অর্জন দৃশ্যমান নয়। তিস্তা, সীমান্ত হত্যা রয়ে গেছে যথারীতি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থানও হতাশার কারণ। উদ্বেগের তালিকায় বরং যুক্ত হলো আসামের নাগরিক তালিকা আর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে ভারতের অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। আর বছর শেষ হলো বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর সফর বাতিলের মধ্য দিয়ে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, ২০১৯-এর শেষে এসে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে এই কথাগুলো বলতে থাকা মনে হয় বেশ কঠিন হয়ে গেছে। গত কিছুদিন এই বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলি শোনাও যায়নি কোনো নেতা-মন্ত্রীর মুখে।

চীন সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন

১৯৭৫–পরবর্তী প্রতিটি সরকারের সঙ্গেই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। (ব্যতিক্রম ২০০৭-০৮-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এ সময়ে খানিকটা আড়ষ্টতা ছিল সম্পর্কে।) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুসমূহে বা বহুপক্ষীয় নির্বাচনে দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। যেসব বিষয়ে চীন স্পর্শকাতর, বাংলাদেশ সেসব ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে চীনকে। উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া মৈত্রী সেতু এবং সম্মেলন কেন্দ্র দৃশ্যমান করেছে সুসম্পর্ককে।

তবে সে সময়টা পেরিয়ে এসেছি আমরা বেশ আগেই। এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চীন। এর সবকিছুই অবশ্য নিরেট আশীর্বাদ নয়। চীন থেকে প্রকল্প অর্থায়ন আসে বাণিজ্যিক সুদে, জাপান বা ইইউর মতো স্বল্প সুদে নয়। চীনা কোম্পানিগুলো কাজ পাওয়ার পর দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়। এক প্রকল্পের কাজ আটকে রেখে চাপ দিয়ে আরেক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। দুর্নীতি, অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি এসব তো আছেই। কোম্পানিগুলো তাদের এসব কাজে চীন সরকারের পরোক্ষ মদদও লাভ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তবু ‘সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু’ এই শব্দগুচ্ছে নন্দিত হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক।

বাংলাদেশ–চীন সম্পর্কে প্রথম বড় ধাক্কা ২০১৭ সালে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারকে চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন। দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্কের সুবাদে চীনের সুযোগ ছিল এ ক্ষেত্রে ‘অনেস্ট ব্রোকার’-এর ভূমিকা নেওয়া। তা না করে চীন ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারকে বেছে নিয়ে মিয়ানমার সৃষ্ট সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে। বাংলাদেশের প্রতি চীনের অসন্তোষের একটি সম্ভাব্য কারণ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের চাপে সরে আসা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর–পরবর্তী চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি ছিল। তিন বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রতিশ্রুতির শতকরা ৫-৭ ভাগের বেশি নয়। এ বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সই হয়েছে কিছু সমঝোতা স্মারক। কিন্তু সম্পর্কের মেঘ কেটে গেছে, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা বিষয়ে নতুন উপলব্ধি

দুই বছর ধরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা না করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের নিন্দা করছে বা জাতিসংঘের মহাসচিব যখন জাতিগত নিধন বলেছেন, তখনো বাংলাদেশ অনেকটাই নীরব থেকেছে।

২০১৯ সালে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। দেরিতে হলেও সম্ভবত এ উপলব্ধিটা এসেছে যে শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা জাতিসংঘে স্পষ্টভাবে বলেছেন। পাশাপাশি এর পুনরাবৃত্তি রোধে মিয়ানমারে যারা জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি ২০১৯ সালে। তবে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি মামলা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, তবে রোম চুক্তির পক্ষভুক্ত না হওয়ায় মিয়ানমারের ওপর এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর্জেন্টিনার আদালতেও চালু হয়েছে একটি মামলা। তৃতীয় মামলাটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে, গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে মামলাটি করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।

নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এই গণহত্যা মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ১০-১২ ডিসেম্বর ২০১৯। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন সে দেশের আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তাম্বাদু। মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন সে দেশের প্রকৃত সরকারপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি।

প্রত্যাশিতভাবেই অং সান সু চি তাঁর বক্তব্যে গণহত্যার সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উত্তর রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ সময় কিছু সেনাসদস্য ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছিলেন বলে তিনি স্বীকার করেন। যুক্তিতর্ক চলাকালে মিয়ানমার পক্ষের আইনজীবী এমনকি এ কথাও বলেন যে সেখানে হয়তো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তবে গণহত্যা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে মামলায় চলমান গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা জারির আরজি আছে। এ আরজিটির নিষ্পত্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। এরূপ নির্দেশনা যদি আসে, তবে সেটা হবে গাম্বিয়া এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটা নৈতিক বিজয়। আর চূড়ান্ত রায়ে মিয়ানমার যদি একটি গণহত্যাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে যেসব দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন করছে, তাদের ওপরও নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের। শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অপরাধের স্বীকৃতিও একটি অর্জন।

বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণের জন্য হেগে উপস্থিত ছিল। মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশ তথ্য–উপাত্ত দিয়েও সহযোগিতা করবে গাম্বিয়াকে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমাধানের ইলিউশন থেকে বের হয়ে আসছে।

আলোচিত তিনটি বিষয় ছাড়াও বৈদেশিক সম্পর্কের ইস্যু আছে আরও অনেক। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক, শ্রমবাজার, মানবাধিকার, বাণিজ্য সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। ২০১৯ সালে এর কোনোটিতেই বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বছরটি পার হয়েছে গতানুগতিক ধারায়।

আসন্ন বছরের চিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট এবং ২০১৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ পুরোনো প্রবাদকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে রাষ্ট্রের জন্য কেবল স্বার্থই হচ্ছে স্থায়ী, বন্ধু বা শত্রু নয়। সংকটকালে ‘পরীক্ষিত বন্ধুরা’ পাশে দাঁড়ায়নি, এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী সময়ের রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে আমাদের। কাউকে শত্রু না বানিয়ে খুঁজতে হবে নতুন বন্ধু, নতুন সমীকরণ, যা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে। নতুন বছরে এটাই হবে বৈদেশিক সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব