Thank you for trying Sticky AMP!!

সন্ত্রাসবাদের পাল্টা আঘাতের যুগ

ব্রহ্ম চেলানি

বিশ্বনেতারা প্রায়ই প্রকাশ্যে বা গোপনে অন্য দেশের সরকার উৎখাত করতে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। এরপর তাঁরা সেখানে নতজানু সরকার বসান এবং তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজনবোধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেন। কিন্তু প্রায়ই এমন হয় যে স্বল্প মেয়াদে যেটা ভালো চিন্তা মনে হয়, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনে। অর্থাৎ এই হস্তক্ষেপের কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো 

দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। আর হস্তক্ষেপকারী দেশগুলো সহিংসতার শিকার হয়। এই ধারাক্রমটি আজকের বাস্তবতায় পুরোদস্তুর দৃশ্যমান। কারণ, যে দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ করেছিল, সেসব দেশে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বাড়ছে।

গত মাসে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করা লিবীয় অভিবাসীর সন্তান ২২ বছর বয়সী সালমান রমাদান আবেদি ম্যানচেস্টারে মার্কিন পপগায়িকা আরিয়ানা গ্র্যান্ডের কনসার্টে আত্মঘাতী হামলা চালান। গত এক দশকে ইংল্যান্ডে এর চেয়ে মারাত্মক হামলা হয়নি। তবে এটাকে শুধু পাল্টা আঘাত হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। যুক্তরাজ্য ও মিত্ররা লিবিয়ায় যা করেছে, তার অভিঘাত হিসেবে এসব ঘটছে। লিবিয়ার মতো দেশে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের কারণে যুদ্ধ-অভিজ্ঞ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে।

যুক্তরাজ্য শুধু লিবিয়াতেই জিহাদিদের সহায়তা করেনি। ন্যাটো নেতৃত্বাধীন যে অভিযানে মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে অপসারণ করা হয়, সেই অভিযানে তারা ব্রিটিশ লিবিয়াসহ বিদেশি যোদ্ধাদের অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিল। সেই যোদ্ধাদের মধ্যে আবেদির পিতাও ছিলেন, যিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের সদস্য ছিলেন। গাদ্দাফির জমানায় এই দলের সদস্যদের কারারুদ্ধ অথবা নির্বাসিত করা হয়েছিল। জ্যেষ্ঠ আবেদি ছয় বছর আগে লিবিয়ায় ফিরে এসে পশ্চিম-সমর্থিত নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী ত্রিপোলি ব্রিগেডের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন।

 ইসলামের সাবেক একজন ‘পবিত্র যোদ্ধা’ যে এই প্রথম পশ্চিমে জন্ম নেওয়া সন্তানের মাঝে জিহাদি ভাবধারা সঞ্চারিত করলেন, তা কিন্তু নয়। গত বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের পালস নাইট ক্লাবের হামলাকারী ওমর সিদ্দিকীও তাঁর পিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ওমরের পিতা ১৯৮০-এর দশকে মার্কিন-সমর্থিত মুজাহিদিনদের হয়ে যুদ্ধ করে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়ন করেন।

বস্তুত সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যা করেছে, এককভাবে আজ সেটিই সন্ত্রাসীদের পাল্টা আঘাতের সবচেয়ে বড় কারণ। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহায়তা ও সৌদি আরবের টাকায় সিআইএ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গোপন অভিযান চালায়। তারা তখন হাজার হাজার সোভিয়েতবিরোধী বিদ্রোহীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র ‘জিহাদ সাক্ষরতা’ কর্মসূচিতে পাঁচ কোটি ডলার ব্যয় করে। সোভিয়েত ‘নাস্তিকদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানদের উৎসাহিত করা এবং সিআইএ-প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের ‘পবিত্র যোদ্ধা’ হিসেবে চিত্রিত করতে তারা এসব করেছে।

সোভিয়েতরা একসময় চলে গেল, যদিও এই পবিত্র যোদ্ধাদের অনেকেই তখন আল-কায়েদা, তালেবান ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গঠন করে। ওসামা বিন লাদেনের মতো মানুষেরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা করেন। যাঁরা এসব সংগঠনে যোগ দেননি, তাঁরা দেশে ফিরে গিয়ে পশ্চিম-প্রভাবিত সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১০ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন স্বীকার করেন, ‘যে সমস্যা আমরা মোকাবিলা করছি, তা আমাদের সহায়তায় সৃষ্টি হয়েছে।’

তা সত্ত্বেও মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও পুরো পশ্চিম এখান থেকে শিক্ষা নেয়নি। হিলারি নিজে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফিকে অপসারণে পরিচালিত অভিযানে সহায়তা দিতে বারাক ওবামাকে রাজি করিয়েছিলেন, যদিও এ ব্যাপারে ওবামা দ্বিধান্বিত ছিলেন।

সিআইএ সিরিয়ার সম্ভাব্য ‘মধ্যপন্থী’ বিদ্রোহী জিহাদিদের আবার সমর্থন দিচ্ছে, যাদের অনেকের সঙ্গেই আল-কায়েদার সম্পর্ক আছে। রাশিয়া নিজের প্রয়োজনে মিত্র বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে সে নিজেও পাল্টা আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৫ সালে সিনাই উপদ্বীপে তার একটি বিমান ভূপাতিত হয়েছিল। সে তালেবানদের দিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক আঘাত করতে চাইছে। আবার ওসামা বিন লাদেনের প্রিয় পুত্র হামজা বিন লাদেন আল-কায়েদার বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক পুনর্গঠিত করতে চাইছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা চিরস্থায়ী হওয়ার পেছনে সেখানকার আঞ্চলিক শক্তিরও ভূমিকা আছে। সৌদি আরব সন্ত্রাসের আরেক পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেও ইরান ও ইয়েমেনের সঙ্গে বর্বর প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে। যে কারণে ইরাক ও লিবিয়ার ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে সৌদি আরব অসহিষ্ণু ও চরমপন্থী ওয়াহাবি ইসলাম রপ্তানি করছে। যেসব পশ্চিমা শক্তি ওয়াহাবি ইসলামকে কমিউনিজম ও ১৯৭৯ সালের ইরানের ‘শিয়া বিপ্লবের’ প্রতিষেধক মনে করত, তারা নীরবে এটা উৎসাহিত করে গেছে।

নতুন মনোভঙ্গি নেওয়ার এটাই উৎকৃষ্ট সময়। ইসলামি মৌলবাদীদের অস্ত্র ও সমর্থন দেওয়া মানে চূড়ান্ত বিচারে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, এটা স্বীকার করে নিয়ে সুবিধাবাদী জোটে যাওয়া চলবে না। সাধারণভাবে পশ্চিমা শক্তিকে হস্তক্ষেপ করার লোভ সামলাতে হবে।

এই যুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ভুল বার্তা দিয়েছেন। প্রথম বিদেশ সফরে তিনি ক্ষয়িষ্ণু ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৌদি আরবে গেছেন। পরিহাস হলো, সেখানে তিনি গ্লোবাল সেন্টার ফর কমব্যাটিং এক্সট্রিমিস্ট আইডিওলজি উদ্বোধন করেছেন। যা হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পাল্টা সন্ত্রাসী আঘাতের সম্মুখীন হওয়ায় আমরা আশা করব, ট্রাম্পের হুঁশ ফিরবে। আর জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০১ সালে যে দৃশ্যত অনিঃশেষ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, ট্রাম্প সেটাকে এমন যুদ্ধে রূপ দেবেন, যা প্রকৃত অর্থে জেতা সম্ভব।

অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক