
বাংলাদেশের সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। রাজধানী ঢাকার ভেতরেই সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর; বিভিন্ন খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও মূল স্থাপনা ঢাকায়। আর সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে ঢাকায় গড়ে উঠেছে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবার মতো অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। যেহেতু ঢাকার বাইরে তেমন একটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি, ঢাকার বাইরে তেমন ভালো শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানও তেমন গড়ে ওঠেনি। অথবা কোনো কোনো শহরে অল্প কিছু ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ সেগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না, সে জন্য তারা সেগুলোর ওপর আস্থা পায় না। সবাই সবকিছুর জন্য ঢাকার ওপরই নির্ভর করতে চায়। সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি থাকে ঢাকার দিকে।
বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ ধারণা হলো, ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে ভালো। সকল প্রকার রোগব্যাধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পাওয়া যায় ঢাকাতেই। এমনকি, দেশে চাকরিবাকরির যতই আকাল হোক, বেশির ভাগ আশাবাদী মানুষ ভাবে, ঢাকায় গেলে একটা না একটা চাকরি পাওয়া যাবে। তাই আমরা দেখছি, ঢাকার আনাচকানাচে গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিপণিবিতানসহ আরও নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। বিশেষত ঢাকায় হাসপাতাল আর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে এবং উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো।
সবাই ছুটে আসছে ঢাকায়। নিজ এলাকায় কাজ নেই, চলো ঢাকায় যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করতে হবে, চলো ঢাকায় যাই। বাজার করতে হবে, চলো ঢাকায় যাই। রিকশা চালাতে হবে বা বুয়ার কাজ করতে হবে, তাও চলো ঢাকায় যাই। আর একবার ঢাকায় এলে এখান থেকে আর কেউ ফিরে যেতে চায় না। আমি এ রকম অনেককে জানি, যাঁরা ঢাকায় সরকারি চাকরি করেন এবং তাঁদের যখন ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়, তখন তাঁরা তদবির শুরু করেন যেন সেই বদলি রদ করা যায়। আর বাইরে থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় আসার জন্য তদবির তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
একটা সময় ছিল, খুব বেশি দিন আগে নয়, মানুষ গ্রাম বা মফস্বল থেকে ঢাকায় আসত এবং স্থায়ীভাবে বাস শুরু করত, কিন্তু নাড়ির টান কখনোই ভুলত না। অন্ততপক্ষে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর আগে গ্রামে চলে যেত অনেকেই, চাইত মৃত্যুটা যেন সেই ছায়া-সুনিবিড় শান্তির গ্রামেই হয়। আর এখন হয়েছে উল্টো। গ্রামের বা মফস্বলের মানুষ মৃত্যুর ঠিক আগে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসে। অনেকের মৃত্যু হয় আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সে আবার অনেকের মৃত্যু হয় ঢাকার হাসপাতালে। মৃত্যুর পর আবার যাত্রা শুরু হয় গ্রামের দিকে। বিষয়টি এমন হয়েছে যে মরতে হলেও যেন ঢাকায় আসতে হবে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনাবিদেরাসহ সবাই বলছেন যে ঢাকা বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে; এখানে ঠিকমতো চলা যায় না, এমনকি নিশ্বাসও নেওয়া যায় না। আমরা সবাই জানি যে ঢাকা শহরে যানজটের কারণে চার কিলোমিটার রাস্তা যেতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। ধুলোবালুতে বাতাস ভর্তি। সারা বছর ধরে চলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি; হয় রাস্তার সংস্কার, নয় বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের সঞ্চালন লাইন মেরামতি, বিস্তার ইত্যাদি। ছিনতাই-রাহাজানি থেকে শুরু করে খুনখারাবি, রাজনৈতিক হানাহানি থেকে শুরু করে অবৈধভাবে সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, এককথায় সব ধরনের অপরাধ ঢাকায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেককেই বলতে শুনি বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, মৃত্যু হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। ঢাকা নিয়ে সবার অভিযোগের অন্ত নেই, কিন্তু কেউ ঢাকা ছেড়ে যেতে রাজি নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিকল্পনাবিদেরা এবং যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাঁদের কেউই ঢাকা ছেড়ে যেতে রাজি বলে মনে হয় না। যদি হতেন, তাহলে সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্র ঢাকায় হতো না।
আমি জানি যে বাংলাদেশের যাঁরা পরিকল্পনাবিদ এবং পরিচালক, তাঁরা পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছেন, থেকেছেন, এমনকি উচ্চশিক্ষাও অর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁরা কতটুকু শিখেছেন বা প্রয়োগ করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করা অযৌক্তিক বলে মনে হয় না। তাঁরা তাঁদের জ্ঞানের যদি সত্যিকার প্রয়োগ করতেন, তাহলে বাংলাদেশের অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামগুলোকেও তাঁরা উন্নত করার চিন্তা করতেন এবং রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে গড়ে তুলতেন বা স্থানান্তর করতেন। এসব প্রতিষ্ঠান যদি ঢাকার বাইরে হতো, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক এলিটরাও ঢাকার বাইরে থাকতেন। ফলে তাঁদের এবং তাঁদের সন্তানদের সেবা দেওয়ার জন্য ঢাকার বাইরে গড়ে উঠত ভালো হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সেবা প্রদানকারী সংস্থা। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশ হতো উন্নত। সবার ঢাকায় থাকার জন্য যে বাসনা, সেটাও থাকত না। ঢাকা হতে পারত বসবাসের উপযোগী একটি শহর।
সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্য এলাকাগুলো গড়ে তোলা গেলে নিঃসন্দেহে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যাবে। অপরাধের কোনো তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় না গিয়েও বলা যায় যে সমাজের এলিট শ্রেণির জমি দখলের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপ অনেক কমবে, যখন মানুষের আর ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা থাকবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, নগরের যেসব স্থানে জনসংখ্যা বেশি, সেখানে অপরাধের মাত্রাও বেশি।
মানুষের যদি কাজ থাকে আর সেই কাজ থেকে যদি আয় হয়, তাহলে মানুষ খুব কমই অপরাধে জড়ায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে উন্নত করে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে অনেক মানুষই গ্রাম বা মফস্বলে বসে ভালো উপার্জন করতে পারবে। তখন স্বাভাবিকভাবে অপরাধের মাত্রাও কমবে। ঢাকা থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া গেলে ঢাকায় তৈরি করা যাবে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ এবং পার্কের মতো সামাজিক বিনোদনের জায়গা। অপরাধের একটি তত্ত্ব বলে, শিশু-কিশোরেরা অপরাধে জড়ায় যখন ইতিবাচকভাবে সময় কাটানোর সুযোগ তাদের থাকে না। তাই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্রচুর পার্ক ও খোলা জায়গা রাখা হয়। এতে বিশেষ করে কিশোরেরা তাদের প্রাণচাঞ্চল্য ও সময় ইতিবাচকভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
বাংলাদেশেও সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে জনসংখ্যার চাপ কমানো যেতে পারে।
ড. মাহফুজুল ইসলাম খোন্দকার: অধ্যাপক, ক্রিমিন্যাল জাস্টিস বিভাগ, কুটসটাউন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।