কয়েক দশকের মধ্যে চরম কূটনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে উপসাগরীয় অঞ্চল। যার সূচনা গত ৫ জুন। সৌদি আরবের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। আর এই ঘোষণা আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের পরপর।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা বিষয়ে মাতবরি করা বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র এই সংকট সৃষ্টিতে কলকাঠি নেড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা অবশ্য রাখঢাক না করেই বিশ্বকে জানান দিয়েছেন দেশটির নেতা ট্রাম্প নিজেই। গত ৬ জুন তিনি প্রকাশ্যেই কাতারকে একঘরে করার সৌদি ঘোষণাকে নিজের কৃতিত্ব বলে দাবি করে বসলেন। নিজেদের অন্যতম মিত্র সৌদি আরবের মতো তিনিও কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ তুললেন।
প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অনেক দেশের বিরুদ্ধেই একক সিদ্ধান্তে যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কাতারের বিরুদ্ধে কেন সৌদি আরব ও তার মিত্রদের ব্যবহার করতে গেল? সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগানের অভিযোগে কাতারের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন নিজে কেন কোনো ব্যবস্থা নিল না?
এর কারণ? যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থ। ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা কাতার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেকটা ‘দুধেল গাভির’ মতো। নানা দিক থেকে কাতারের মাধ্যমে ফায়দা লুটছে দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যে কাতারেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত। আল উদেইদ নামের এই বিমানঘাঁটিতে এই মুহূর্তে প্রায় ১১ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। আছে আধুনিক যুদ্ধ রসদ-সরঞ্জামের সমাবেশ। মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো দেশে এত মার্কিন সেনা-রসদ-সরঞ্জাম নেই। ইরাকে আগ্রাসন ও বর্তমানে সিরিয়া যুদ্ধে কাতারের এ ঘাঁটি দারুণ উপকারে এসেছে মার্কিন বাহিনীর। এ ছাড়া বন্ধু ইসরায়েলকে সহায়তা, শত্রু ইরানকে চাপে রাখা আর তেলসমৃদ্ধ জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর ওপর নিরঙ্কুশ মোড়লত্ব বজায় রাখতে এই বড় সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অস্ত্র ক্রেতাও কাতার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাতারের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের এফ-১৫ জঙ্গি বিমান বিক্রির পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটির প্রধান বব কোরকার ওই পরিকল্পনায় ভেটো দিয়ে বলেছেন, চলমান কাতার সংকট সমাধানের আগে এটা চূড়ান্ত করা যাবে না।
এ ছাড়া ইরানকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের মনে কাতারকে নিয়ে আরেকটি ভয় কাজ করে। সেটা হলো, কাতার যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়, তাহলে ইরান তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে। সৌদির সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণার পরপর ইরান খাবারভর্তী কয়েকটি বিমান পাঠিয়ে তা প্রমাণও করেছে। তাই কাতারকে সরাসরি চটালে কি আর যুক্তরাষ্ট্রের চলে!
এ কারণেই কি না প্রথমে বন্ধু সৌদি আরবের সঙ্গে সুর মেলালেও ট্রাম্প গত ৭ জুন সরাসরি ফোন করেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে। সৌদিসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব দূর করতে আমিরকে মার্কিন সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করা যেতে পারে বলেও আমিরকে জানান তিনি। ট্রাম্পের এই ফোন দেওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন কাতারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য সৌদি ও তার মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। তখন মনে হচ্ছিল, ওয়াশিংটন বোধ হয় এই সংকট আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু এটা যে ট্রাম্পের ‘সর্প হইয়া দংশনের পর ওঝা হইয়া ঝাড়ার’ ভূমিকামাত্র, সেটা বোঝা গেল দুদিন পরই। গত ১০ জুন হোয়াইট হাউসে উল্টো সুর তুললেন ট্রাম্প। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে আবারও সন্ত্রাসবাদে কাতারের অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি।
এর মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন ও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্ররা বিভিন্ন সময় একবার সৌদি আরবের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন তো আরেকবার আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের জন্য কাতারকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা ১৩ শর্ত দিয়ে কাতারকে তা মানতে ১০ দিনের সময়সীমা দিয়ে দেয়। সেই সময়সীমা শেষ হলে আরও ৪৮ ঘণ্টা সময় বাড়ানো হয়। সেই সময়ও শেষ হয়েছে। কিন্তু কাতার তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে ওই ১৩ শর্তের কোনোটাই না মানার ঘোষণা দেয়। ১৩ শর্তের অন্যতম হলো আল-জাজিরা বন্ধ করা, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ করা ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কেও মাত্রা সীমিত করে আনা। এই শর্তগুলো গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায়, এগুলো তো পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রেরই শর্ত! ২০০৩ সালে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার সময় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর বিপরীত স্রোতে থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদনেই তো যুদ্ধক্ষেত্রের আসল চিত্র পায় বিশ্ববাসী। আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের অডিও-ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোকে ছাড়িয়ে যায় আল-জাজিরা। যেটা যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের ভালো লাগেনি।
যা-ই হোক, উপসাগরীয় অঞ্চলের চলমান এই সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। তবে ১৯ জুলাইয়ের খবর হলো, আল জাজিরা বন্ধের দাবি থেকে সরে এসেছে সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলো। কিন্তু কট্টরপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাতারকে ছয়টি নীতি গ্রহণের প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এতে কাতার সংকট সমাধানে একটি প্রাথমিক পথ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে অবশ্য ১৫ জুলাই ট্রাম্প সিবিএন নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, কাতারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। তাঁর এই বক্তব্যের পরই সৌদি জোটের সুর নরম হলো কি না, কে জানে!
এদিকে সংকট সমাধানে দূতিয়ালি চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র কুয়েত। সেটাও তো মনে হয় ওয়াশিংটনের ইঙ্গিতেই! তা-ও যদি সমাধান হয়! তবে কুয়েত যতই চেষ্টা করুক যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্প হইয়া দংশনের পর ওঝা হইয়া ঝাড়ার’ ভূমিকা না ছাড়লে এই সংকটের কোনো সমাধান হবে না, সেটা বোধ হয় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
manik.mahfuz@gmail.com