গাজীপুর সিটি করপোরেশনের হাতিমারা এলাকায় ১৬ মে রাতে নিজামউদ্দিন (২৫) নামের এক যুবক নিজের ১০ মাস বয়সী ছোট ভাইকে কূপে ফেলে হত্যা করেছেন। নেশা করার জন্য মায়ের কাছে তিনি টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু মা টাকা দিতে অস্বীকার করেন। আর তাতেই রাগ হয়ে যায় নিজামউদ্দিনের। রাগের মাথায় ছোট ভাইকে কূপে ফেলে দেন। ১৮ মে প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি দৈনিকে মর্মান্তিক এ খবর ছাপা হয়। খবরটি পড়ে ঘাতক বড় ভাই ও নিহত ছোট ভাই দুজনের জন্যই দুঃখ অনুভব করি। গভীর এক বেদনায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কারণ, দুজনের এই করুণ পরিণতির জন্য তারা নিজেরা কেউ দায়ী নয়। দায়ী এ সমাজব্যবস্থা, এ রাষ্ট্রব্যবস্থা।
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর ও তরুণ। আমরা যারা এখনো মাদকে আসক্ত হইনি, তারা মাদকাসক্তদের ঘৃণা করি। তাদের আমরা এড়িয়ে চলি। ছেলেমেয়েদের নিষেধ করি তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখি, কেন তারা মাদকে আসক্ত হলো? এর জন্য তারা নিজেরা কতখানি দায়ী?
মাদকদ্রব্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করা অবৈধ হলেও এ দেশে মাদকের জমজমাট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীর লক্ষ্য হচ্ছে কিশোর ও তরুণেরা। রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এটি অসম্ভব। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নাকের ডগায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা বড়ি, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। কিন্তু কেউ তাঁদের কিছু বলছে না। এমন অভিযোগও রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন পুলিশের সদস্যরা। সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশের চোখের সামনেই সীমান্তে চলছে মাদকের অবৈধ জমজমাট ব্যবসা। খোদ রাজধানীতে গড়ে উঠেছে মাদক বেচাকেনার অসংখ্য ‘স্পট’। এসব স্পটের কথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানেন। জেনেও তাঁরা চুপ থাকেন। কখনো কখনো অবশ্য এসব স্পটে লোক-দেখানো অভিযান চালানো হয়। দেশে রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সরকারি এই সংস্থা মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে যে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না, তা মাদকের অবাধ বিস্তারে তো বোঝাই যাচ্ছে।
তবে শুধু রাষ্ট্রের ওপর দোষ চাপালে হবে না, পরিবারও, সমাজও শিশু ও তরুণদের মাদকাসক্ত হওয়ার জন্য দায়ী। বাবা-মা সন্তানের প্রতি প্রকৃত অর্থে দায়িত্বশীল হলে কখনোই একটি ছেলে বা একটি মেয়ে মাদকে আসক্ত হতে পারে না। বাড়ন্ত বয়সে ছেলেমেয়েদের প্রতি মা-বাবার উদাসীনতা তাদের মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। ছেলেমেয়েরা কাদের সঙ্গে মিশছে, তার প্রতি লক্ষ না রাখলে তাদের মাদকে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সামাজিক বৈষম্য অল্পবয়সীদের মাদকে আসক্ত হওয়ার একটি বড় কারণ। সামাজিক বৈষম্যের কারণে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মাদক থেকে এর মুক্তি খোঁজে। লেখাপড়াসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তরুণসমাজকে মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আর এ মাদকের ভয়াবহ ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুণসমাজ। প্রথমে কৌতূহলের বশে মাদক গ্রহণ করলেও একসময় তা নেশায় পরিণত হয়। আর নেশা যখন অদম্য হয়ে ওঠে, তখন তা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু মাদক কিনতে গেলে তো চাই টাকা। অনেকে এ টাকা পরিবার থেকে পায় না। তখনই তারা বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে খুন করে ভাইকে, বোনকে, মাকে, বাবাকে। করছে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি। নিচ্ছে প্রতারণার আশ্রয়। অনেকে আত্মহত্যা করছে। চিরচেনা ছেলেটি বা মেয়েটি পরিবারের কাছে কেমন অচেনা হয়ে যায়।
আমরা চাই না আর একটি প্রাণও মাদকের বলি হোক। সর্বনাশা এ মাদককে রুখতে হবে। আর এ কাজটা করতে হবে রাষ্ট্রকে। আমাকে, আপনাকে ও গোটা সমাজকে।