Thank you for trying Sticky AMP!!

সাংবিধানিক নৈতিকতাকে অবহেলা করা যায় না

সব গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানের মতো বাংলাদেশের সংবিধানও আইন ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে রচিত। সমাজ শুধু রাষ্ট্রের তৈরি কিছু আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত হয় না, সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা নৈতিক মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব বি আর আম্বেদকর বলেছেন, সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, সিভিল সোসাইটির সদস্য এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’ মেনে চলতে হবে। তা না মেনে চলা ফৌজদারি অপরাধ না হতে পারে, কিন্তু ঘোরতর অন্যায়।

রাষ্ট্রে যত রকম সাংবিধানিক পদ রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন পার্লামেন্টের মেম্বার। তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। সাংসদদের কে কয়টি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন বা মনোনীত হয়েছেন, তা নিয়ে মাথা ঘামানো নিষ্প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত হওয়ার পর যখন সাংসদ হিসেবে একজন ‘সশ্রদ্ধচিত্তে’ শপথ গ্রহণ করেন, তখন তাঁকে বলতে হয়, ‘আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’ কত মহৎ প্রতিজ্ঞা! যিনি এ রকম শপথ করতে পারেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মানুষের মাথা নত না হয়ে পারে না।

ষাটের দশকে আমার পরিচিত কৃষি তথ্যকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে আইএ, বিএ এবং ৬২ বছর বয়সে এমএ পাস করেন। অত বেশি বয়সে পাসের জন্য পত্রিকায় তাঁর ছবিসহ খবর বেরিয়েছিল। তাতে তাঁর গৌরবহানি তো হয়ইনি, বরং বেড়েছিল। পরলোকগমনের অল্প আগে বাংলায় মাস্টার্স করায় মানুষ তাঁর নিষ্ঠার প্রশংসা করেছিল।

পার্লামেন্টের মেম্বার হতে কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন জনগণের সমর্থনের। কলিকালে সেটারও প্রয়োজন নেই। অবলীলায় হওয়া সম্ভব। কোনো কারণে একজন সাংসদের আগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, সাংসদ হওয়ার পর তাঁর উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। শিক্ষা বোর্ডে প্রয়োজনীয় ফি জমা দেন। তার পরের কাজটি হলো পরীক্ষার দিন হলে গিয়ে অন্যান্য পরীক্ষার্থীর সঙ্গে খাতায় প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়া। সে উত্তর সঠিকও হতে পারে, বেঠিকও হতে পারে। সেটা কোনো দোষের ব্যাপার নয়।

আমাদের একজন মাননীয় আইনপ্রণেতা অধ্যবসায়সাধ্য সে পথে গেলেন না। তিনি ক্ষমতার অধিকারী, আইনকানুন তৈরিতে অতি ব্যস্ত, তাই সে পথে না গিয়ে শর্টকাট একটি পথ বের করলেন। তাঁর পিএস বা এপিএসকে পাঠিয়ে দিলেন পরীক্ষার হলে। ব্যক্তিগত সহকারীকে দিয়ে নির্বিঘ্নে পরীক্ষাটা দেওয়াতে পারলে অনায়াসে জিপিএ-৫ পেতেন। কিন্তু বিঘ্ন ঘটল। ভদ্রলোক হাতেনাতে ধরা পড়লেন। বস্তুত শনাক্ত হলেন জোচ্চোর হিসেবে। ধরা পড়েও পড়লেন না। দিলেন এক ভোঁ-দৌড়। পরীক্ষাকেন্দ্রের কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলেন। দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

অন্যকে দিয়ে নিজের পরীক্ষা দেওয়ানো শুধু দুষ্কর্ম নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যিনি অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিতে গেছেন, তিনিও দণ্ডনীয় অপরাধ করেছেন। এ ধরনের কাজ অতীতে যাঁরা করেছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কমবেশি শাস্তি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও হয়তো আইনের কঠোর প্রয়োগ হতো, যদি পরীক্ষার্থী হতেন বিরোধী দলের সাংসদ। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী, যিনি তাঁর প্রক্সি দিতে গিয়েছিলেন, তাঁর কবজিতে শৃঙ্খলযুক্ত লৌহবলয় পরিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হতো। আলোচ্য ক্ষেত্রে বিষয়টি সযত্নে ধামাচাপা দেওয়া হয়।

যে সাংসদ এই অপকর্ম করেছেন, তাঁরই জেলার তাঁরই দলের এক নেত্রী এখন সংবাদ শিরোনাম। এই নেত্রী ফিলিপাইনের ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের মতো ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকারী হয়ে ওঠেন। ইমেলদার ছিল ৫০০ জোড়া জুতা-স্যান্ডেল। আমাদের নেত্রী ইচ্ছা করলে পাঁচ হাজার জোড়া জুতা কিনতে পারতেন, সে আর্থিক সামর্থ্য তাঁর ছিল। ইমেলদা নিজের হাতে কোনো নারী বা পুরুষকে মারধর করেছেন, তেমনটি জানা যায় না, ইনি সে কাজটি করেছেন। বহু বাঙালি পুরুষ আমৃত্যু সেই দুঃসহ স্মৃতি বহন করবেন। তাঁর কিন্নরীদের দিয়ে বঙ্গীয় পুরুষদের সঙ্গে যে লীলাখেলা করিয়েছেন, তার ফলে এখনো যে বাংলাদেশে প্রতিবাদী পুরুষবাদের উত্থান ঘটেনি, তা আশ্চর্যের বটে। এভাবে নেত্রী ও তাঁর ক্যাডারদের হাতে পুরুষেরা নিগৃহীত হতে থাকলে বাংলাদেশ পুরুষ পরিষদ গড়ে উঠতে দেরি হবে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যথাযথ বিরতি দিয়ে সরকারি দলের, বিশেষ করে তাদের সহযোগী সংগঠনের দু-একজন নেতাকে পাদপ্রদীপের তলায় নিয়ে আসেন। এতে সরকারবিরোধীরা খুশিতে বগল বাজান। লজ্জিত হওয়াকে সরকারি দলের নেতারা অপছন্দ করেন। যাঁরা সরকারের সত্যিকারের হিতাকাঙ্ক্ষী, তাঁরা বিব্রত হন। তাঁরা কষ্টও পান।
একটি বড় দলে, বিশেষ করে যে দল এক যুগের বেশি সময় যাবৎ ক্ষমতায়, তার ও তার সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতা সারা দেশে। তাঁদের অনেকে সরকারের স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য পান, অধিকাংশই ছিটেফোঁটা পেয়েই ধন্য। অনেকে কিছু চানও না, চাইলেও বিশেষ কিছু পান না, নীতি ও আদর্শের কারণে মাটি কামড়ে দলে পড়ে থাকেন।

দলের ও সহযোগী সংগঠনের একটি ছোট অংশই দুষ্কর্ম ও জঘন্য অপরাধে লিপ্ত। তাঁরা অকল্পনীয় দুর্নীতি করেন, সরকারি সম্পত্তি দখল করেন, নদীর বালু চুরি করেন, তীর দখল করে নদী ভরাট করেন, বনভূমি উজাড় করেন, পাহাড় কেটে সাবাড় করেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেন, বাংলাদেশের মেয়েদের বিদেশের পতিতালয়ে নিয়ে বিক্রি করতে তাঁদের বিবেকে বাধে না, মাদক খাইয়ে যুবসমাজকে ধ্বংস করেন, তাঁরা জুয়া খেলেন এবং নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে রাত কাটান। তাঁদের সম্পদের পরিমাণ এত বেশি, যা রূপকথার চরিত্রকে হার মানায়।

সম্রাটসমূহ ও পাপিয়াকুল আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক জগতের বাস্তবতা। প্রথাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে যে নতুন ধারার রাজনীতি সূচিত হয়েছে, তাতে সম্রাটদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হবে এবং মাঝারি পাপিয়ায় ভরে যাবে পল্লি পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, সম্রাট ও পাপিয়াদের কাজকর্ম ও জীবনযাপন র‍্যাব-পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে দলের নেতাদের চোখে কি একটুও পড়ল না? সাবালক ও সাবালিকা বাঙালিরা এবং দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ মনে করে, দল ও সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায়ই তাঁদের উত্থান। যত দিন ব্যবহৃত হওয়ার, হয়েছেন। যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছেন বলে সরকার মনে করেছে, তখন কলার খোসার মতো ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।

রাজনীতিতে আগে মাস্তান ছিল, মক্ষীরানি ছিল না। রাজনীতিতে পেশিশক্তি ছিল, যৌনসঙ্গী ছিল না। রাজনৈতিক নেতারা থাকতেন সুখে-দুঃখে জনগণের মধ্যে, পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে নয়। আম্বেদকর কথিত সাংবিধানিক নৈতিকতা থেকে যদি রাজনৈতিক নেতারা বিচ্যুত হন, তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ—দুই-ই ধ্বংসের দিকে যাবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক