Thank you for trying Sticky AMP!!

সিরিয়া বিষয়ে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ

সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ার মাত্র শুরু, অনেক পথ পেরোতে হবে

সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শুক্রবার যে প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে, তাকে নিঃসন্দেহে সিরিয়া বিষয়ে এযাবৎকালের সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করা যায়। এই প্রস্তাব গ্রহণের ফলে সিরিয়া সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পথ সুগম হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রস্তাব পাস হওয়ার অর্থ হলো প্রস্তাবের প্রতি, অর্থাৎ এই প্রস্তাবে যে ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে তার প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ফলে এই শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। যদিও এই প্রস্তাব হচ্ছে এযাবৎকালের সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ, এটিকে প্রথম পদক্ষেপ বললে ভুল হবে। আমার বিবেচনায় গত কয়েক মাসে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে এটি তৃতীয়।
চার বছরের বেশি সময় ধরে অব্যাহত গৃহযুদ্ধ সিরিয়াকে ক্ষতবিক্ষত করছে, কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষের প্রাণনাশ করেছে, তার ভয়াবহ পরিণতি কেবল দেশ হিসেবে সিরিয়াকেই বইতে হচ্ছে তা নয়, ইতিমধ্যে তার একটি আঞ্চলিক রূপ তৈরি হয়েছে। দেড় বছর ধরে এই অঞ্চলে আইএস বলে যে ভয়াবহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি, যে সংগঠন ইরাক ও সিরিয়ার এক বড় এলাকাজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের একটি রাষ্ট্র বলে দাবি করছে, তার উদ্ভবের কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ নয়। কিন্তু আইএসের শক্তি বৃদ্ধি ও ভৌগোলিক পরিধি বিস্তারের পেছনে যে এই যুদ্ধের ভূমিকা রয়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরতদের সাহায্য করার নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের গৃহীত পদক্ষেপ আইএসকে অনেকাংশেই শক্তিশালী করেছে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, পশ্চিমা দেশগুলো এবং তুরস্ক প্রত্যক্ষভাবে আইএসকে মদদ দিচ্ছে এবং তার উপস্থিতি থেকে সুবিধা লাভ করছে। এই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ রাশিয়া এসে যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে। যদিও অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে রাশিয়া বলেছে যে সে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হচ্ছে। কিন্তু এ কথা সবাই জানেন যে রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিপদগ্রস্ত মিত্র বাশার আল আসাদের সরকারকে রক্ষা করা।
পশ্চিমা দেশগুলো ২০১২ সালে সিরিয়ার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য জেনেভায় বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেয় এই কারণে যে তারা গোড়াতে সামরিকভাবে বাশার আল আসাদ সরকারকে সরাতে পারবে বলে মনে করলেও ২০১২ সাল নাগাদ বুঝতে পারে, সেটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত জেনেভায় আলোচনা চলে। সেই চেষ্টায় রাশিয়া যুক্ত থাকলেও শক্তিশালী আঞ্চলিক দেশ ইরানের অংশগ্রহণ ছিল না এবং অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে এই আলোচনা সফল হবে না। তাঁদের আশঙ্কা সত্য হয়েছিল, কেননা বাশার সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষ আশা করছিল, তাদের প্রতিপক্ষ অচিরেই দুর্বল এবং ক্রমান্বয়ে পরাজিত হবে। এই আশা সরকারের চেয়ে বিরোধীদেরই বেশি ছিল। ২০১৪ সালে আইএসের উত্থানের প্রেক্ষাপটে গোটা পরিস্থিতির বদল ঘটে, আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর আরও দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে; প্রথমত, ব্যাপক সংখ্যায় শরণার্থীরা ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি জমায়; দ্বিতীয়ত, সেপ্টেম্বরে রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করে। যুদ্ধক্ষেত্রে একধরনের অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সব পক্ষই বুঝতে পারে তাদের আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে হবে।
সেই উপলব্ধির কারণেই এ বছরের অক্টোবরের শেষ নাগাদ ভিয়েনায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। এটি ছিল সিরিয়া সমস্যা সমাধানে প্রথম পদক্ষেপ। ইরানের অংশগ্রহণ, আলোচনায় রাশিয়ার অংশীদারির মাত্রা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির অংশগ্রহণ ছিল এই আলোচনার ইতিবাচক দিক। ক্ষমতাসীন বাশার সরকারের আগের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকাটাও উল্লেখযোগ্য বিষয়, যা একার্থে আলোচনার অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে; কেননা তারা বুঝতে পেরেছে যে এই পরিস্থিতি সামরিকভাবে সমাধান করা যাবে না কিন্তু শক্তিশালী অবস্থান থেকে আলোচনা করে যতটা সম্ভব আদায় করে নেওয়ার এই সুযোগ যেকোনো সময়ে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। যেহেতু রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে থাকতে নারাজ ও অপারগ, যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসে ইরানের অংশগ্রহণে সম্মত ও বাশারের ক্ষমতাচ্যুতিকে শর্ত হিসেবে আরোপ করেনি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভবিষ্যতে যেন আর ‘শরণার্থী সমস্যা’ পরিস্থিতির সূচনা না হয়, সে জন্য দ্রুত সমস্যা সমাধানে উৎসাহী ছিল, ভিয়েনা আলোচনার সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল বেশি। সেই সাফল্যও আসে ১৪ নভেম্বর, প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার এক দিন পরেই। অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয়ে একমত হয় যে সিরিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প নেই। সেই সময়ে এই বিষয়ে ঐকমত্য হয়, ১ জানুয়ারি জাতিসংঘ সিরিয়ার সরকার ও বিরোধীদের আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য ডাকবে; ১৪ মে ২০১৬ সালের মধ্যে সরকার ও বিরোধীরা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে ও নতুন সংবিধান তৈরির কাজ শুরু হবে এবং ১৪ মে ২০১৭ সালের মধ্যে নতুন সংবিধানের অধীনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আমার কাছে যেটা দ্বিতীয় পদক্ষেপ বলে মনে হয়, সেটা এক জায়গায় ঘটেনি। ডিসেম্বরের ৮-১০ তারিখ তিনটি শহরে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ভিয়েনা আলোচনার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের উদ্যোগে যখন শান্তি আলোচনা হবে, তাতে কে বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। এই তিনটি বৈঠকের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বৈঠকটি হয় সৌদি আরবের রিয়াদে। বাকি দুটি হয় সিরিয়ার ভেতরে কুর্দি অধ্যুষিত রুমেলিয়ান শহরে এবং রাজধানী দামেস্কে। দামেস্কের বৈঠকের উদ্যোক্তা ছিল বাশার আল আসাদ সরকার, উদ্দেশ্য জাতিসংঘের আলোচনায় ‘সিরিয়ার বিরোধী দল’ বলে সরকারি পোষ্যদের হাজির করার জন্য প্রস্তুত থাকা। রুমেলিয়ানে যারা একত্র হয়েছিল, তারা অধিকাংশই ছিল কুর্দিদের সমর্থনপুষ্ট সংগঠন। যদিও তাদের কয়েকটি সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, তথাপি তারা রিয়াদের বৈঠকে যেতে রাজি হয়নি তুরস্ক এবং অন্য কিছু গোষ্ঠীর ভূমিকার কারণে। রিয়াদের দুই দিনের বৈঠকের ১০০ জন প্রতিনিধি কেবল পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট বলেই নয়, তাঁদের নিজস্ব ভূমিকার কারণেও গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশেই প্রতিনিধিত্বশীল। তাঁদের এই বৈঠকে নারী প্রতিনিধিদের সংখ্যাল্পতা নিঃসন্দেহে এই প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে দুর্বলতার প্রমাণ। রিয়াদের বৈঠকের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে যে বিরোধী গোষ্ঠীগুলো তাদের মতপার্থক্য সত্ত্বেও অনেক বিষয়ে কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয় এবং ৩৩ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে তাদের মধ্যকার সব পার্থক্যের অবসান হয়েছে। এবং তাদের সঙ্গে যদিও কুর্দি গোষ্ঠীরা আছে, তথাপি রুমেলিয়ানে অংশগ্রহণকারীদের কিছু গোষ্ঠীকে যুক্ত করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তথাপি যে ক্ষেত্রে আগে বিরোধীরা আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করছিলেন, সেখানে এই বিষয়ে তাঁদের সম্মতি ও প্রতিনিধি নির্বাচন ইতিবাচক।
এই দুই সফল পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করেই এখন জাতিসংঘ তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবের মূল দিক হলো এই যে তাতে সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদের অপসারণের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, অন্যদিকে জানুয়ারির শুরুতেই যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনা শুরু, ছয় মাসের মধ্যে সবার অংশগ্রহণমূলক নতুন সরকার এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এসব আলাদা আলাদা বিষয় হলেও এগুলো অবিভাজ্য। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটা হবে না। ফলে এখন পর্যন্ত যে সাফল্য, তা একার্থে পটভূমি তৈরি করেছে।
যেকোনো শান্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেমন, এ ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত ‘মাঠের পরিস্থিতি’ এবং বাশার আল আসাদের সরকার ও তাঁর বিরোধীদের আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করবে এর সাফল্য। কিন্তু প্রধান দুই বহিঃশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে একমত হয়েছে যে এই প্রক্রিয়া সিরিয়ানদের নেতৃত্বেই হতে হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক; আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা মেনে নিয়েছে সামরিকভাবে এর সমাধান হবে না, রাজনৈতিক সমাধানই হচ্ছে একমাত্র উপায়। এই অঞ্চলের আঞ্চলিক শক্তিগুলো—ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরব এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় রাশ টানবে কি না, সেটাও অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেবে সিরিয়া পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধান হবে কি না। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির যেমন আঞ্চলিক প্রভাব আছে, তেমনি এই শান্তি প্রক্রিয়া সফল হলে তারও প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলে, বিশেষ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ার মাত্র শুরু, এখনো অনেক পথ পেরোতে হবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।