Thank you for trying Sticky AMP!!

সুবর্ণজয়ন্তীর বিবর্ণ চিত্র ও সরকারের হেফাজতপ্রীতি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে এখন ক্ষমতাসীন মহলে নানা রকম ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, হেফাজতের ঘাড়ে ভর করে বিএনপি–জামায়াত এসব ঘটিয়েছে। কেউ বলছেন, হেফাজতে নামের সংগঠনটিকে বেশি আশকারা দেওয়া হয়েছে

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে এখন ক্ষমতাসীন মহলে নানা রকম ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, হেফাজতের ঘাড়ে ভর করে বিএনপি–জামায়াত এসব ঘটিয়েছে। কেউ বলছেন, হেফাজতে নামের সংগঠনটিকে বেশি আশকারা দেওয়া হয়েছে। আবার কারও মতে, আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নেতৃত্বের বিভক্তিই এসব অঘটনের কারণ।

কিন্তু আসল কারণটি কেউ বলছেন না। রাজনীতি যখন সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় চলে না, যখন মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থাকে না, তখন এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। দেশে যে দীর্ঘদিন ধরে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে উপলক্ষ করে তার বিস্ফোরণ ঘটল। মোদির সফরের বিরোধিতার বিষয়ে সরকার কী করবে, তা যেমন ঠিক করতে পারেনি, তেমনি কী হতে পারে, তা–ও আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে এ রকম কিছু ঘটতে পারে, তার আগাম গোয়েন্দা তথ্য সরকারের কাছে ছিল না। অথচ হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন কর্মসূচির আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। (প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০২১)

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা। যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই অবিভক্ত পাকিস্তান সিকি শতাব্দীও টেকেনি। এখনো পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র আছে, যা বিভিন্ন গোত্র, জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত। জাতিগত সমস্যা থেকে মুক্ত নয় ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারও। সেদিক থেকে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ দেশ হতে পারত, যদি রাজনীতি সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় চলত। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে যাঁরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই নিজেদের বাংলাদেশের একচ্ছত্র মালিক ভাবেন। অন্য কাউকে কোনো জায়গা দিতে চান না। সরকার বিরোধী দলকে দেশের শত্রু ভাবে, বিরোধী দলও সরকারকে শত্রু ভাবে। এই শত্রু শত্রু খেলা চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশের রাজনীতি প্রচণ্ডভাবে বিভক্ত, সেই বিভক্তি ছড়িয়ে আছে সমাজে, দলে-উপদলে। একাত্তরে আমাদের অভিন্ন শত্রু ছিল পাকিস্তানিরা। পাকিস্তানিরা যখন চলে গেল, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করলাম। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে যখন রাজনৈতিক ঐক্য খুব জরুরি ছিল, তখনই যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য নিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দলটি কিছুদিনের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভক্তির পেছনে কতটা রাজনৈতিক আদর্শ আর কতটা নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা ঠিক করতে পারিনি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ কী। নেতারা কেবল স্লোগান দিয়েছেন, বাক্যবাণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছেন। আদর্শের জায়গাটি তৈরি করেননি। বলা হয়, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই রাষ্ট্রের মৌলনীতি। একই সঙ্গে আছে রাষ্ট্রধর্ম। আছে ধর্মভিত্তিক দলও। যদি আমরা দেখতাম, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী কিংবা ২০–দলীয় জোটই কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, তাহলে খুশি হতাম। বহু বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে এবং প্রায় ‘গৃহবন্দী’। কিন্তু এখন দেখছি, ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগও একইভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটে অন্তত তিনটি দল আছে, যারা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করে। নব্য সখা হেফাজতে ইসলাম তো আছেই।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যা ঘটল, তার পেছনে একজন বিদেশি অতিথির আগমনের বিরুদ্ধে কেবল মহল বিশেষের প্রতিবাদ ছিল, তা ভাবার কারণ নেই। এই ঘটনায় গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে গণমানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন।

আওয়ামী লীগ নিজেকে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে দাবি করে। কিন্তু বাস্তবে তারা তাতে কতটা আস্থাশীল, তা নিয়ে সংশয় আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আহূত জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকটি ভাষণ বাজিয়ে শোনানো হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে সেই সব ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ উধাও হয়ে যায়। এই কাজটি বিএনপি বা অন্য কোনো দল করলে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেত। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ করেছে, তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করছেন।

বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি পরিষ্কার। ক্ষমতার গর্ভজাত দুটো দলই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। দুটো দলই ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে মিত্র ভাবে, একসঙ্গে জোট, নির্বাচন ও সরকারও করে। তাহলে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বটি আদর্শের নয়, ক্ষমতার। এ কারণেই এক দল জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে, আরেক দল হেফাজতকে তোয়াজ করে। আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে যতই বলুন, বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই, মনে মনে বিএনপিকেই ভয় করেন।

মোটা দাগে হেফাজত ও জামায়াতের মধ্যে একটি ফারাক করা হয়, জামায়াত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে হেফাজতের জন্ম হয়েছে ২০১০ সালে। এটি যেমন সত্য, তেমনি অসত্য নয় হেফাজত জামায়াতের চেয়েও গোঁড়া, ধর্মান্ধ। জামায়াত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে। হেফাজত প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটুও বদলায়নি। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত একাডেমি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, সরকারি–বেসরকারি স্থাপনা, রেলস্টেশন ইত্যাদি। এর আগেও তারা এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করতে গিয়েই এই সংগঠনের জন্ম। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের নামে তারা কী করেছে, তা–ও নিশ্চয়ই সবার জানা। হেফাজত তার অবস্থান থেকে এক কদম সরেনি, বরং সরকারকে বারবার পিছু হটতে বাধ্য করেছে। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী সরকার পাঠ্যবই অদলবদল করেছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরিয়েছে।

আওয়ামী লীগ দাবি করে, তারাই দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত দল, তাদের আছে লাখ লাখ ত্যাগী ও অদর্শবাদী নেতা-কর্মী। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, কিশোরগঞ্জ কিংবা নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় এই আদর্শবানদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমেও ধাওয়া খেয়ে পিছু হটেছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা। কার নির্দেশে তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন?

আমরা এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় আরেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য দেখতে চাই না, সেটি যে নামেই হোক না কেন। জনগণের জানমাল হেফাজতের দায়িত্ব যে সরকারের, তারা কী করেছে? প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির ১০০ লোকের সমাবেশ ঠেকাতে সরকার দেড় শ পুলিশ সদস্য নামাতে পারলে কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারল না? পুলিশপ্রধান বলেছেন, যারা জনগণের সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু মামলার ধরন তা প্রমাণ করে না। অভিযোগ আছে, হেফাজতের চেয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের নামেই বেশি মামলা হয়েছে।

সবশেষে একটি প্রশ্ন করতেই হয়। যে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে এত ‌‘দক্ষতা ও সফলতা’ দেখিয়ে আসছে, তারা এ রকম একটি কাঁচা কাজ কীভাবে করল? তারা কি হেফাজতের আন্দোলনকে আপসের খেলা ভেবেছিল? নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে কি এ রকম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, পুলিশ দেখলেই হেফাজতের কর্মীরা মাঠ ছেড়ে সুড়সুড় করে ঘরে চলে যাবেন?

তাহলে কি হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে এমন কোনো আপসরফা হয়েছিল, যা তাঁদের কর্মীরা মানেননি?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com