তুলনামূলক দেশের অন্যান্য অনেক শহরের চেয়ে বরিশালের নাগরিক জীবনব্যবস্থা কিছুটা হলেও গোছানো। বাংলার ভেনিস নামে পরিচিত বরিশাল শহরের পরিচ্ছন্ন নগরব্যবস্থা খুব দীর্ঘদিনের না হলেও বর্তমানে মানুষের কাছে বরিশাল একটি পরিষ্কার, ময়লা-আবর্জনামুক্ত শহর হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু হতাশার বিষয়, বরিশালের এই পরিচ্ছন্ন গুণের ব্যত্যয় এখন ধীরে ধীরে বরিশালকে বিষিয়ে তুলেছে। নগরের অনেক ব্যস্ততম স্থানে ময়লা-আবর্জনা ও নিষ্কাশনব্যবস্থা আগের মতো গতিশীল নয়। প্রধান প্রধান রাস্তার পাশে থাকা ডাস্টবিন ঘিরে সন্ধ্যার পর দেখা যায় গৃহপালিত পশুর খাদ্য অনুসন্ধান। ফলে চলাচলে যেমন তৈরি হচ্ছে অসুবিধা, তেমনি সৃষ্টি হচ্ছে যানজট ও দুর্ঘটনা। রাতের রাস্তায় যেখানে-সেখানে ভ্রাম্যমাণ কাঁচাবাজার, চা-সিগারেটের দোকান, যা আগে এতটা পরিলক্ষিত হয়নি, তা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বরিশাল শহরের সদর রোড নামের রাস্তা, নামে যা-ই মনে হোক, রাস্তা কিন্তু মোটেও প্রশস্ত নয়। আবার সেই রাস্তার ওপর বসছে এসব শাকসবজির দোকান। রাতের আঁধারে নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাকগুলো এই রাস্তায় ঢুকে পড়ে, সেখানে রাস্তার কাঁচাবাজার শহরের নিরাপদ চলাচলের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সম্প্রতি বরিশাল সিটি করপোরেশন ‘মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পার্ক’কে ভেঙে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কবরস্থান নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রথমেই বলা দরকার, বরিশাল শহরের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জন্য বিনোদন, পার্ক, উদ্যান প্রয়োজনের তুলনায় কতখানি কম বা বেশি। ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’ (বেলস পার্ক), ‘শিশু প্ল্যানেটেরিয়াম’, ‘মুক্তিযোদ্ধা পার্ক’ ছাড়া শহরের কাছাকাছি তেমন কোনো উদ্যান বা খোলা জায়গা নেই। এর মধ্যে আবার দুটি পার্ক সর্বজনীন আর প্ল্যানেটেরিয়াম উন্মুক্ত পার্ক নয়। শহরের অধিকাংশ মানুষই হাঁটাচলা তথা শারীরিক ব্যায়ামের জন্য একনামে বেলস পার্ককেই জানেন। প্রতি সকাল ও সন্ধ্যায় যুবক থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষ উন্মুক্ত এই পার্কে আসেন দৌড় ও হাঁটার জন্য। কোনো একটি শহরের পরিচয় হয় তার পরিকল্পিত জনসংখ্যার সঙ্গে নগরব্যবস্থা, উন্মুক্ত উদ্যান, খেলাধুলার মাঠ, পয়োনিষ্কাশন—এগুলোর আনুপাতিক উপস্থিতি ও বিন্যাসের ওপর। সেই অর্থে বরিশাল শহরের উদ্যান তথা মুক্ত বিনোদনের জায়গা খুবই কম। এরপর যদি তৈরি করা মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পার্ককে কবরস্থানে রূপান্তরিত করা হয়, তবে তা শহরের শুধু সৌন্দর্যেরই হানি হবে না, উপরন্তু একটি আদর্শিক শহরের জন্য বরিশাল অনুপযোগী হবে। কেননা, এই পার্কে সব ধরনের মানুষ পরিবারসহ ঘুরতে আসে একটুখানি যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে।
মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পার্কটি মূলত কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহর বরিশালে হওয়ায় মানুষকে এটি অধিক আকৃষ্ট করে। এখানকার ঝাউগাছ, কাঠবাদামগাছ, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ইতিমধ্যে বড় হয়ে ছায়া দেওয়া শুরু করেছে। এই মুহূর্তে এই পার্ককে কবরস্থানে রূপান্তরিত করলে ব্যাপক সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছপালা কেটে ফেলতে হবে, আর জায়গাটি হয়ে যাবে সংরক্ষিত। বিশেষ কিছু দিন ছাড়া এই পার্কটি মানুষের জন্য হয়তো উন্মুক্তও থাকবে না। একটি কবরস্থান তৈরি করতে লাগে কিছু নির্মাণসামগ্রী কিন্তু একটি বিনোদন পার্ক, যা আগে থেকেই তৈরি করা, সেখানে কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে গাছগাছালি, সেগুলোর ধ্বংসসাধন না করে ভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কবরস্থান নির্মাণ করা হোক। বরিশাল শহরে খুঁজলে এমন জায়গা পাওয়া তেমন কঠিন কিছু নয়। কবরস্থানকে ব্যবহারের উপযোগী করতে সময়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির প্রয়োজন হয় না কিন্তু একটি নতুন পার্ক গড়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। কারণ, পার্কের মূল সৌন্দর্যই থাকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে। বরং সিটি করপোরেশনের এ বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত যে পার্কটিকে কবরস্থান করলে নদীতীরবর্তী শহরে এমন একটি মনোরম পরিবেশ আর না-ও পাওয়া যেতে পারে।
শুধু পার্ক রক্ষা নয়, সিটি করপোরেশনকে পার্ক ব্যবস্থাপনার দিকটিতেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। কেননা, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, যেখানে বরিশালের বড় অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন হয় আবার সব বয়সের মানুষ যেখানে হাঁটতে আসেন, সেখানে প্রায়ই দেখা যায় গরু চরে বেড়াচ্ছে। মাঠের ঘাসগুলো বড় হয়ে এত লোভনীয় হয়েছে যে অবাধে সেখানে এমন ঘটনা ঘটছে। এমনকি ছিন্নমূল লোকজন বা টোকাইয়েরা পার্কের হাঁটার ট্র্যাকের ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে হাঁটাচলা ও দৌড়াতে আসা বয়সী লোকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দুই প্রান্তে বিদ্যুৎ-সংযোগ দুটি ভিন্ন লাইন থেকে হওয়ায় প্রায়ই কোনো প্রান্ত অন্ধকারে পড়ে থাকছে। অত্যধিক লম্বা ঘাসের কারণে মাঠে মশার উপদ্রব, ফলে মাঠে এসে মানুষ স্বস্তিতে বসতে পারছে না।
বরিশাল শহরের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য আছে তিন ধরনের মাধ্যম—চার্জার অটো, মাহিন্দ্র ও রিকশা। চার্জার গাড়িগুলোর সংখ্যা এত বেশি যে সেখানে রিকশার সংখ্যা তুলনামূলক কম। অধিক চার্জার গাড়ির কারণে চার্জারচালকেরা নিয়মিত যাত্রী না পাওয়ায় যানজটের সৃষ্টি করছেন অধিক সময় দাঁড়িয়ে থেকে। নতুন চার্জার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাই ভেবে দেখা দরকার, যাতায়াতের জন্য চাহিদা কতটুকু। অনেক চার্জারের ফিটনেস কোনোভাবেই চলাচলের উপযুক্ত নয়। ফলে বিপরীতমুখী গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ একটি নিয়মিত ঘটনা। মাহিন্দ্র নামের গাড়িগুলোর বিকট শব্দ থাকায় মনে হয় এ ধরনের গাড়িগুলো শহরে চলতে দেওয়া উত্তম নয়।
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর’—নগরের মাঝে অরণ্য না হোক, উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা হোক। বরিশাল সিটি করপোরেশন আবার প্রশংসামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাবতীয় সমস্যা দূর করুক ও ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন পার্ক’কে কবরস্থান করার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসুক—এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
সঞ্জয় সরকার: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।