বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, কথাটা বলেছেন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। আমাদের অফিসে প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক ছিল। সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ও প্রথম আলোর এই আলোচনা সভা তখন শেষ হয়েছে মাত্র। দুপুরের খাওয়ায় ব্যস্ত সবাই। হঠাৎ লক্ষ করলাম, চেয়ারে বসে একজন মোবাইলে কথা বলছেন। তিনি চোখে দেখেন না। কাছে গেলাম। ভাবলাম, কেউ নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করছেন। না। তিনি নিজেই একের পর এক বিভিন্ন নম্বরে ফোন করছেন। কাজের নির্দেশনা দিচ্ছেন। কথা শেষ হলে আবার আরেকজনকে ফোন করছেন। আসলে তিনি তাঁদের সাভারের অফিসে বিভিন্ন কর্মীকে
বলছেন কার কী করতে হবে। তাঁর অফিসে যেতে দেরি হবে, ইত্যাদি।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। চোখে দেখেন না, তাহলে ফোন করছেন কীভাবে? রহস্যটা কী? পরে বুঝলাম, আসলে তিনি কানে শুনে বিভিন্ন নম্বরে ফোন করছেন। তাঁর স্মার্টফোনে একটি বিশেষ সফটওয়্যার বসানো আছে। অনুমানে একটা নম্বর টিপলে ফোনই বলে দেয় ওটা কার নম্বর। মিলে গেলে তিনি কথা বলা শুরু করেন।
আমি কল্পনাও করতে পারিনি প্রযুক্তি এত দূর গিয়েছে। ভাবতাম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা শারীরিক প্রতিবন্ধীরা অসহায়। অন্যের সাহায্য ছাড়া তাঁদের চলে না। কিন্তু বুঝলাম, তাঁদের একটু সহায়তা দিলে যেকোনো ব্যক্তির মতোই তাঁরা কাজ করতে পারেন।
তাঁর নাম এ কে জি গোলাম মহিউদ্দিন। তিনি সিডিডির ট্রেনিং সেন্টারের একজন অ্যাসোসিয়েট কো-অর্ডিনেটর। সবাইকে প্রশিক্ষণ দেন।
তিনি সগর্বে বলেন, ‘এই দেখেন, আমিও স্মার্টফোন চালাতে পারি।’
আমরা জানি, একজনের যদি কোনো একটি ইন্দ্রিয় কাজ না করে, তাহলে বাকি চার ইন্দ্রিয় এমনভাবে কাজ করে যে অকেজো ইন্দ্রিয়টির অভাবে জরুরি কাজ আটকে থাকে না। আপনি কানে শোনেন না, তাই কথাও বলতে পারেন না। কিন্তু তাতে কী? আপনার চোখ, নাক, জিব ও ত্বক স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে। আপনি কিন্তু অন্যদের চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়ে উঠবেন।
চোখেমুখে বিদ্যুৎ খেলে যাবে। কথা না বলেও সবকিছু নিজে বুঝবেন আর অন্যদেরও বোঝাতে পারবেন। এটা আমাদের অনেকের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের অনেকে পিএইচডি করে বেশ উঁচু দরের চাকরিও করেন। হয়তো আমাদের দেশে কম। বিলাত, আমেরিকায় অজস্র উদাহরণ রয়েছে।
মানুষের শরীরেই এসব প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। বুদ্ধির জোর প্রতিবন্ধীদের অনেক বেশি। তাই তাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারলে দেশ ও সমাজ অনেক বেশি উপকার পায়।
আমাদের সংবিধানে রোগ-শোক, জরা-ব্যাধিতে আক্রান্ত, অসহায়-গরিব, কোনো কারণে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ব্যক্তিসহ সবার চিকিৎসার সুব্যবস্থার কথা বলা আছে। কাজটা কঠিন, সন্দেহ নেই। তারপরও বলব, এখনো সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা-সুবিধা অনেক। বিশেষভাবে, গরিব-সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা এই সরকারি হাসপাতাল। এখন দেখতে হবে সেই হাসপাতালগুলোতে প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধা কতটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সমস্যাগুলো বের করা আর করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা সামনে নিয়ে আসা দরকার।
দেখুন তাঁদের সমস্যা কোথায়। মো. ইব্রাহীম হোসেন পাবনা থেকে এসেছেন। তিনি সিডিডির সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়ক দলে কাজ করছেন। নিজেও প্রতিবন্ধী। তাঁর অভিজ্ঞতা খুব দামি। কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক বলেন, ‘বাইরের দোকান থেকে এক্স-রে করিয়ে নিয়ে আসেন।’ কারণ, সবাই জানেন, হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনটা হয়তো অনাদিকাল ধরে নষ্ট হয়ে আছে। এদিকে বাইরে যেতে হলে তাঁর পক্ষে একা যাওয়া-আসা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর হয়তো শরীর অবশ। তাঁকে হুইলচেয়ারে চলতে হয়। তার ওপর বাইরে এক্স-রে করতে তিন গুণ বেশি খরচ। আবার কখনো বলা হয় অমুক বিভাগ থেকে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে আনেন। সেই বিভাগটা দোতলায়। তিনি যাবেন কীভাবে?
ইব্রাহীম ভাই মনে করেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। হুইলচেয়ার ব্যবহার করে ওপরে–নিচে যাওয়া যায়, টয়লেটে যাওয়া যায়, এমন ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। আর যাঁরা এই রোগীদের চিকিৎসা দেবেন, তাঁদের একটু ভালো বুঝবাজ থাকতে হবে। একটু সংবেদনশীল হতে হবে। না হলে চলবে কেন?
সরকারের নির্দেশ আছে। এই তো সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভুটানে বলেছেন, ‘বিশ্বের সব দেশ যেন প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। আমাদের দেশেও সেই উদ্যোগ আছে। তবে সবখানে করতে হবে।’ মুশকিলটা হলো, আমাদের দেশে এই প্রতিবন্ধীদের সমস্যার বিষয়টি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নয়। এ তো একেবারে সাক্ষাৎ গোড়ায় গলদ। যার মাথাব্যথা থাকা দরকার, তার এখতিয়ার নেই। আর যার এখতিয়ার, তার তো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মালমসলা নেই। তাহলে চলবে কীভাবে?
তাই সেই গোলটেবিল বৈঠকে সবাই বলেছেন, প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা যেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়। তাহলে সহজেই কমিউনিটি ক্লিনিকের আওতায় তাঁদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা যাবে। প্রতিবন্ধীদেরও গ্রাম থেকে শহরে দৌড়াতে হবে না।
আরেকটা কথা। অন্তত সব জেলা হাসপাতাল পর্যায়ে যেন একজন করে ফিজিওথেরাপিস্ট রাখা হয়। কারণ, বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীর জন্য থেরাপি দরকার। বেসরকারি থেরাপি চিকিৎসায় খরচ কয়েক গুণ বেশি।
তা ছাড়া সব হাসপাতালে অন্তত একজন করে ইশারা ভাষা জানা কর্মী থাকতে হবে। না হলে বাক্প্রতিবন্ধীরা চিকিৎসকের কাছে তাঁদের অসুবিধার কথা জানাবেন কীভাবে? টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে অন্তত ১১টি লক্ষ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের বিষয়টি জড়িত। ৩ নম্বর লক্ষ্যটি তো সরাসরি স্বাস্থ্য খাতবিষয়ক। এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে আমরা তো প্রতিবন্ধীদের পেছনে ফেলে রাখতে পারব না।
ধরুন, আপনি স্মার্টকার্ড নিতে গেলেন। আপনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অথবা আপনার হাতের আঙুলগুলো নেই। আপনার জন্য কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। না হলে আপনি তো গণনায় বাদ পড়ে যাবেন। স্মার্টকার্ড না থাকলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারবেন না।
দেশের প্রতিবন্ধীদের আমরা যদি একটা করে পরিচয়পত্র দিই, যেখানে লেখা থাকবে একটি কথা—‘সুবর্ণ নাগরিক’। তাহলে বোধ হয় অনেক উপকার হবে। সব খানে তাঁরা চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে অন্যান্য সহযোগিতা সহজে পাবেন। আর যদি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের হাতে একটা করে স্মার্টফোন দিই, যেখানে সেই বিশেষ সফটওয়্যারটি বসানো আছে, তাহলে তো কথাই নেই। আসুন, আমরা অন্তত এই কাজটুকু করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com