বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

'আসুন, বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি'

এ বছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ডিপ্রেসন-লেট’স টক’, অর্থাৎ ‘আসুন, বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি’। জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতিপাদ্যটি বিশ্বের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিষণ্নতা রোগের বোঝা এর সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করবে। কোনো মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলে সেটির কারণে তার ব্যক্তিজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পারিবারিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়; পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক বিষণ্নতাযুক্ত নাগরিকের অনুৎপাদনশীলতা ও চিকিৎসাব্যয়ের কারণে রাষ্ট্র ও সমাজে বিষণ্নতা আর্থসামাজিক প্রভাব তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিদিন তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে, বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে—এর মধ্যে বেশির ভাগ আত্মহত্যাই ঘটে বিষণ্নতার কারণে। আত্মহত্যা প্রতিরোধেও বিষণ্নতা শনাক্ত আর প্রতিকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিষণ্নতাকে কেবল একজনের ব্যক্তিগত রোগ হিসেবে ভাবার কারণ নেই, জনস্বাস্থ্যে বিষণ্নতার প্রভাব ব্যাপক।

বিষণ্নতাকে জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বিষণ্নতাকে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) তৃতীয় লক্ষ্যে সুস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সবার কল্যাণকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্যসহ সামগ্রিক এসডিজি অর্জনের জন্য বিষণ্নতাকে প্রতিরোধ করতে হবে এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে গেলে বিষণ্নতার কারণগুলো দেখতে হবে। সাধারণত শারীরিক, মানসিক আর সামাজিক কারণে বিষণ্নতা হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্টের সমস্যা ইত্যাদিতে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এই দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোকে দ্রুত শনাক্ত আর নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মানসিক কোনো টানাপোড়েন আর ব্যক্তিত্বের গড়ন বিষণ্নতার জন্য দায়ী। তাই মানসিক চাপমুক্ত থেকে ব্যক্তিত্বের গড়নকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে শিশু অবস্থা থেকেই সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। সামাজিক বৈষম্য, অস্থিরতা, বঞ্চনা আর দারিদ্র্য মনের ওপর বিশেষ চাপ তৈরি করে। এই চাপ থেকে কারও কারও মধ্যে বিষণ্নতা হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা যদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, শিশু অবস্থায় যদি কেউ কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়, তবে ভবিষ্যতে তার মধ্যে বিষণ্নতা হতে পারে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আর আদর্শ বাবা-মা হওয়া জরুরি। কোনো দুর্যোগের পর আক্রান্ত জনগোষ্ঠী বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, ফলে তাদের বিষণ্নতা হতে পারে। দুর্যোগের পরপরই ‘প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ দিলে বিষণ্নতা প্রতিরোধ করা যায়।

বিষণ্নতার কারণগুলোর দিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নতা নিয়ে কুসংস্কার আর ভ্রান্তবিশ্বাস কমাতে হবে। বিষণ্নতা একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা। এটির দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত কুপ্রভাব সম্পর্কে সবাইকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তথ্য প্রদান করতে হবে। বিষণ্নতাকে যত দ্রুত নির্ণয় করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি এটি নিরাময় হবে এবং ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কমতে থাকবে। ফলে অপচিকিৎসার দ্বারস্থ না হয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে বিষণ্নতা নির্ণয় ও চিকিৎসা করা প্রয়োজন। বিষণ্নতার চিকিৎসার জন্য প্রচলিত ভ্রান্তবিশ্বাস দূর করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ওষুধ সেবন করতে হবে এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং সেবা নিতে হবে। কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিয়মিত বিষণ্নতার ওষুধ সেবনের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

সব পর্যায়ের স্বাস্থ্য পেশাজীবী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক মহল, প্রচারমাধ্যম এবং সচেতন সমাজের কার্যকরী ভূমিকা বিষণ্নতা প্রতিরোধ, দ্রুত শনাক্ত এবং প্রতিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এ বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আসুন, বিষণ্নতা নিয়ে কথা বলি।

আহমেদ হেলাল: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা